॥ শাহ ফখরুজ্জামান ॥
চট্টগ্রাম এর সাথে সিলেট অঞ্চলের যোগাযোগ মাধ্যম হিসাবে এখনও সবচেয়ে জনপ্রিয় রেল যোগাযোগ। বিকল্প ব্যবস্থাগুলো মানসম্মত না হওয়ায় এবং দুরত্ব বেশী হওয়ায় রেলের উপরই সবার আস্থা। এক সময় মেইল ট্রেন জালালাবাদ। পরে আসে আন্তঃনগর পাহাড়িকা এক্সপ্রেস। সর্বশেষ উদয়ন এক্সপ্রেস। সবগুলো ট্রেনেই নির্ধারিত আসনের অধিক টিকেট বিক্রি হয় সব সময়। বিকল্প ভাল ব্যবস্থা না থাকায় স্ট্যান্ডিং টিকেটেই ভ্রমণ করেন অনেক যাত্রী। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে এই লাইনের ট্রেনগুলোর নিয়মিত যাত্রী ছিলাম। সাথে বিশ^বিদ্যালয়ের শাটল ট্রেন ভ্রমণ মিলে কত হাজার মাইল ট্রেনে ভ্রমণ করেছি তার হিসাব মেলানো অনেক কষ্ঠকর। তবে ইদানিং খুব একটা যাওয়া হয়না বন্দর নগরীতে। ফলে ট্রেনগুলোর হাল হকিকত খুব একটা জানা নেই। শুক্রবার সকালে বিশেষ প্রয়োজনে চট্টগ্রাম যাই বাসে করে। কিন্তু কুমিল্লার কোম্পানীগঞ্জ ও দেবীদ্বার এলাকায় রাস্তার করুণ দশা আর ভয়াবহ যানজটে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় দুই ঘন্টা। বাসের স্টাফদের সাথে আলোচনা করে বুঝতে পারি শুক্রবার হওয়ায় কম সময়েই যানজট এড়ানো গেছে। ফলে ফিরতি পথে বাসে আসার আর সাহস করতে পারিনি। রাতে যখন ট্রেনের টিকেটের অনুসন্ধান শুরু করি তখন জানতে পারি শনিবার উদয়ন এক্সপ্রেস বন্ধ। ফলে শুধু রাত্রি যাপন করেই শনিবার সকালের পাহাড়ীকা এক্সপ্রেসেই ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেই। স্টেশনে গিয়ে দেখি আগের মত টিকেটের লম্বা লাইন নেই। ভাবলাম সহজেই টিকেট পেয়ে যাব। কিন্তু কাউন্টারে গিয়ে জানতে পারি নির্ধারিত আসন আগেই শেষ হয়ে গেছে। এক্সট্রা বগি আছে দুটি। সেটির টিকেট দেয়া হয় সিলেট স্টেশনের। কিনে নেই সিলেট পর্যন্ত টিকেট। বুকিং মাস্টার টিকেট দিয়ে যখন ভাংতি ফেরত দিলেন সেখানে তিনি রেখে দিলেন ৫ টাকা। এটি অনেক পুরনো সংস্কৃতি। আর কাউন্টারে লাইন না থাকায় বিষয় হল এখন অনলাইনেই চলে যায় অধিকাংশ টিকেট।
টিকেট নিয়ে ৮নং প্লাটফর্মে গিয়ে দেখি নতুন একটি ট্রেন দাঁড়ানো। খবর নিয়ে জানতে পারলাম এটি নতুন ট্রেন। আজই এটি উদ্বোধন হবে। যদিও কয়েকদিন পূর্বেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ট্রেনটির শুভ উদ্বোধন করেছেন। কিন্তু যাত্রা শুরু হবে আজ থেকে। মনে মনে নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবলাম। নতুন একটি ট্রেনের যাত্রা শুরুর দিনেই যাত্রী হতে পেরেছি বলে। ট্রেনে উঠেই সুন্দর আসন এবং ঝকঝকে তকতকে অবস্থা দেখে। গাড়ীর স্টাফরাও পরিপাটি হয়ে এসেছেন। স্টেশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও অনেক ফিটফাট। মনে হয়েছে বিদেশের কোন ট্রেন বা স্টেশনে আছি আমি। সকাল ৯টায় গাড়ী ছাড়ার কথা। ঠিক যথাসময়েই হুইশেল বাজিয়ে ছেড়ে দেয় ট্রেন। মনে মনে আশায় বুক বাধি। মনে হয় ভাল যাত্রাই হবে এবার।
কিন্তু ট্রেনটি ছাড়ার পরই দেখি অনেক যাত্রী স্ট্যান্ডিং টিকেট নিয়ে এখানে সেখানে দাঁড়ানো। একের পর এক হকারের চেচামেচি। দানগ্রহণকারীরা আসছেন একের পর এক। গাড়ী স্বাভাবিক গতিতেই অগ্রসর হতে থাকে। কিছুক্ষণ পর একবার দাঁড়িয়ে যায় ট্রেন। কিন্তু এক মিনিট পরই ছেড়ে দেয়। ফেনী পর্যন্ত যথাসময়েই চলে ট্রেন। এরপর থেকেই শুরু হয় বিপত্তি। কিছুক্ষণ পরপরই ট্রেন থেমে যায়। হয়তবা কেউ শিকল টেনেই ট্রেনটিকে থামিয়ে যাত্রীরা যত্রতত্র নামার আয়োজন করে। এভাবে স্টেশন ছাড়াই ৬ স্থানে থামে ট্রেন। এর মাঝে কুমিল্লার পর বুড়িচঙ্গে ছিল ক্রসিং। অন্যগুলো বিনা কারণেই থামে। আখাউড়ার পর প্রায় স্টেশনেই গাড়ী থামে এবং যাত্রী উঠানামা করে। মুকন্দপুর, হরষপুর ও মনতলায় নির্ধারিত স্টপেজ না থাকার পরও গাড়ী দাঁড়ানোতে যাত্রা বিলম্ব ঘটে অনেক।
আমরা হবিগঞ্জবাসী হিসাবে হিজড়াদের উৎপাত নিয়ে কম বেশী সকলেই অবগত। তবে পাহাড়িকা ট্রেনে দেখলাম দফায় দফায় হিজড়াদের অভিযান। টিটিও ট্রেনে এতবার অভিযান পরিচালনা করে নাই। তবে দফায় দফায় এক টিমই অভিযান করেনি। আলাদা আলাদা টিম এসে যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নেয়। চট্টগ্রাম থেকে শায়েস্তাগঞ্জ পর্যন্ত আমি যে কামড়ায় ছিলাম সেটিতে তিনটি টিম আসে টাকা নেয়ার জন্য। প্রথম টিমকে সহজেই সবাই ১০/২০ টাকা করে দেয়। ২য় টিম আসার পর কেউ কেউ বিরক্ত হলেও টাকা দেন। কিন্তু তৃতীয় টিম আসার পর অনেকেরই ধৈর্য্যরে বাধ ভেঙ্গে যায়। কেউ কেউ প্রতিবাদ করে বলেন, আমরা আরও দুইবার টাকা দিয়েছি। তখন এক হিজড়া বলে বাবার যদি বেশী সন্তান হয় তাহলে কি সবাইকে বাবা টাকা দেয় না। আর একজন বলে- ভাই আপনি ত আর প্রতিদিন চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে আসেন না। একদিন না হয় কয়েকজনকে কিছু টাকা দিয়েই দিলেন।
এভাবেই ট্রেনটিতে হকার, হিজড়া আর স্ট্যান্ডিং যাত্রীদের ছোটাছুটিতে সোয়া ৪টায় আসি শায়েস্তাগঞ্জ। নতুন ট্রেনে উঠার পর শুরুতে যে ভাললাগা সৃষ্টি হয়েছিল শেষ পর্যন্ত এসে মনে হয়েছে ‘যেই লাউ সেই কদু’র মত অবস্থা। একজন যাত্রী মন্তব্য করে এটি গরুর গাড়ীর মত চলে। আরেকজন বলে মনে হচ্ছে এটি একটি লোকাল ট্রেন। আমার উপলব্ধি হল শুধু নতুন বগি আর সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করেই ট্রেন এর সেবা বৃদ্ধি পাবে না। এর জন্য প্রয়োজন মান সম্মত ব্যবস্থাপনা। লোকাল ট্রেনের মত নির্ধারিত স্টেশনের বাহিরে আর যত্রতত্র ট্রেন দাঁড়িয়ে যাত্রী নামবে এটি হতে পারে না। আর ট্রেনের ভিতর যাত্রীরা যখনই একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয় তখই যদি হকার আর হিজরার চেচামেচি শুরু হয় তাহলে ভ্রমণ কিভাবে আরাম দায়ক হবে। পূর্বের ট্রেনে স্টেশনের পূর্বে স্পিকারে ঘোষনা থাকত। মাঝে মাঝে গানও বাজত। কিন্তু এখানে এগুলোও ছিল অনুপস্থিত। আর বিপুল চাহিদার পরও এই ট্রেনের বগি পর্যাপ্ত নয়। আরও আসন বাড়ানো প্রয়োজন। শুধু তাই নয় এই লাইনে চাইলে আরও আন্তঃনগর ট্রেন চালু করলেও আসন পূর্ণ হবে এটি নিশ্চিত করে বলা যায়। আমার এই উপলদ্ধি সবার সাথে শেয়ার করলাম। কিন্তু নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে যদি সেই কথা বলা না যায় তাহলে আমাদেরকে এই ভোগান্তির যাত্রাই মেনে নিতে হবে সব সময়।