ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
সিঙ্গাপুর নয় আজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের দেশ মালয়েশিয়ার গল্প বলব। একজন দেশপ্রেমিক সফল রাষ্ট্রনায়ক মাহাথির মোহাম্মদের কথা বলব। একজন ডাক্তার রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় তার দেশপ্রেমকে পূজি করে কিভাবে মাত্র দুই যুগ সময়ের ব্যবধানে একটা সাধারণ মানের দেশ থেকে বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশে রূপান্তরিত করেছেন তার কথা বলব। বহু ধর্ম এবং বহু জাতি গোষ্ঠী সম্বলিত অগোচালো একটা দেশকে যিনি উন্নত, রুচিশীল ও মার্জিত জনসাধারণের স্বর্গীয় এক আবাসভূমি হিসেবে তৈরি করেছেন তারই কথা। ক্ষমতা গ্রহণের সময় যে দেশটির দরিদ্র জনগোষ্ঠী ছিল ৩৫%, মাথা পিছু আয় ছিল ১৩০ ডলার, সেখানে ২২ বছরে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় তা দাঁড়ায় ৩৩৩০ ডলারে। ক্ষমতা গ্রহণের দশ বছর পর দেশের সকল বেকারত্ব দূর করে দেশের বাহির থেকেও আট লক্ষাধিক কর্মী আমদানি করা হয়। আত্মবিশ্বাসী মাহাথির মোহাম্মদ বলতেন ‘আমাকে দশজন যুবক দাও, আমি মালয়ীদের নিয়ে বিশ্ব জয় করব।’
১৯৭৬ সাল। আমরা যখন সিলেটে চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হই, আমাদের সাথে চার মালয়ী বন্ধুও ভর্তি হন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে মালয়েশিয়া তখন আমাদের থেকে অনেক পিছনে। এরই মধ্যে ন¤্রভদ্র অমায়িক সালেহ্ এর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে অল্পদিনেই। একদিন আলাপচারিতায় তাঁর দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস সম্বলিত তাঁর উত্তর যা ছিল তার মর্মার্থ হল গড়পড়তায় বাংলাদেশের অভিজাত শহর সিলেটের ধারেকাছেও মালয়েশিয়ার অবস্থান তখন নেই। আর আজ মাত্র চার যুগের ব্যবধানে মালয়েশিয়া আমাদের কাছে স্বপ্নের দেশ, বিশ্বের অন্যতম পর্যটনের দেশ, অনেক ধনকুবেরের নিকট সেকেন্ড হোম বা দ্বিতীয় আবাসভূমি গড়ে তোলার দেশ।
এর মূলে আসল কারণ হল নিখাঁদ দেশপ্রেম। রাজনৈতিক সমালোচনা যে ছিল না তা নয় তদপি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছাড়ার ১৫ বছর পর মাহাথির মোহাম্মদ নিজের হাতে গড়া দলের দুর্নীতি দেখে দেশের প্রয়োজনে বিরোধী দলের সাথে হাত মিলিয়ে ৯৩ বছর বয়সে পুনরায় দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
শাবাশ মাহাথির! শাবাশ মালয়েশিয়া!! শাবাশ দেশপ্রেম!!!
মাহাথির মোহাম্মদ হৃদরোগে আক্রান্ত হলে উন্নত চিকিৎসার নিমিত্তে অপারেশনের জন্য বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। তিনি দেশের সাধারণ জনগণের কথা ভেবে দেশের বাহিরে চিকিৎসা নিতে অস্বীকার করলেন। সাধারণ চিকিৎসা নিয়ে ঝুঁকির মাঝেই দু’বছর কাটিয়ে দিলেন। উন্নত দেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করিয়ে দু’বছর পর নিজের দেশের ডাক্তার দিয়ে নিজ দেশেই হৃৎপিন্ডের অপারেশন করালেন। সমগ্র দেশবাসীর জন্যও সে সুযোগ তৈরি করে দিলেন। ইতিহাসের পাতায় দেশপ্রেমের এক অনন্য নজির স্থাপন করলেন কালজয়ী এ রাষ্ট্রপ্রধান।
শুধু তাই নয়, প্রায় দেড় লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রীকে বিভিন্ন বিষয়ে উন্নত দেশ থেক পড়াশোনা করিয়ে নিজদেশে বিভিন্ন পদে মোটা বেতনে নিয়োগদান করলেন। সুখকর বিষয় হল একজন ছাত্রছাত্রীও ডিগ্রি লাভের পর বিদেশে অবস্থান করেননি। সবাই দেশে ফিরে দেশের উন্নয়নে জনসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। মোদ্দাকথা এটাই হল দেশপ্রেম এবং দেশের প্রতি ভালবাসার এ বীজ রোপন করেছিলেন স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধান নিজেই।
আমাদের দেশটাও প্রাকৃতিক এবং ভৌগোলিক দিক থেকে মালয়েশিয়ার চেয়ে মোটেও কোন অংশে কম নয়। আমি মনে করি এক অমিত সম্ভাবনাময়ের দেশ আমার এই বাংলাদেশ। দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য দেশপ্রেমকে যদি মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় তবে জন্মগত ভাবেই আমরা দেশপ্রেমিক। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে মায়ের ভাষার জন্য বুক পেতে বন্দুকের গুলিতে শাহাদাত বরণ সমগ্র বিশ্বে এক বিরল ইতিহাস। অতঃপর একটা নির্দিষ্ট দিনকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসে রূপান্তর কম গৌরবের নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল এ দেশমাতৃকাকে নিরঙ্কুশ ভালবাসারই ফলশ্রুতি। রণাঙ্গন থেকে ফিরে আসার জন্য কেউ যুদ্ধে যায়নি, হাসিমুখেই দেশের মাটিকে রাঙ্গা খুনে রঞ্জিত করে লাল সবুজের পতাকা উত্তোলন করার মানসিকতায়ই দু’কাপড়ে মাতা পিতা, ভাই বোন, স্ত্রী, সন্তান সন্ততি বা প্রেয়সীকে ছেড়ে গেরিলা যুদ্ধের উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়েছিল বাংলার দামাল ছেলেরা। পাকিস্তান সরকারের স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্ত হয়ে নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, লুটেরাদের হাত থেকে দেশটাকে উদ্ধার করে উন্নত সুন্দর একটা দেশ বিনির্মাণই ছিল একমাত্র স্বপ্ন। ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ের গণতন্ত্র উদ্ধার আন্দোলনে নুর হুসেন এবং ডা. মিলনের আত্মাহুতিও একই সুতোযদ বাঁধা।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিনা রক্তক্ষরণে স্বাধীনতা লাভ করে আজ যদি সিঙ্গাপুর উন্নতির চরম শিকড়ে আরোহন করতে পারে, মাত্র তিন যুগের ব্যবধানে একজন দেশপ্রেমিকের হাত ধরে যদি মালয়েশিয়া বিশ্বে চমক সৃষ্টি করতে পারে তবে এত ত্যাগ, তিতিক্ষ্মা, আত্মাহুতি, সম্ভ্রমহানি বৃথা যাওয়ার কোন কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। যেভাবে আমাদের অতীত ইতিহাস ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত, সারা বিশ্বের দরবারে দেশপ্রেমের এক উৎকৃষ্ট গৌরবোজ্জ্বল উদাহরণ রচনা ও খচিত করে রেখেছে তেমনিভাবে উন্নত এক সমুজ্জ্বল ভবিষ্যতেরও হাতছানি এবং সম্ভাবনা আমাদের সামনে রয়েছে বৈ কি। সিকাগোতে মাত্র ছয়জনের আত্মবলিদান যদি সারা বিশ্বে শ্রম আইনে আমূল পরিবর্তন সাধন করতে পারে, এক চে গুয়ে ভারা যদি জীবন দিয়ে লক্ষ তরুণের হৃদয়ে স্পন্দন জাগাতে পারে, এক নুর হুসেন ও ডা. মিলন যদি জীবন দিয়ে ক্ষমতাধর স্বৈরশাসকের ত্বড়িত পতন ঘটাতে পারে, তবে লক্ষ লক্ষ শহীদের খুন বৃথা যাবে তা হতে পারে না, ইতিহাস তা বলে না।
আজ লক্ষ লক্ষ নয় বরং কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন, আশা-আকাক্সক্ষা একটা সুন্দর, উজ্জ্বল বাংলাদেশ গড়ে তোলার।
আমরা আশাবাদী অবশ্যই একদিন ‘আমরা করব জয়।’
দেশকে কালিমা মুক্ত করতে বা যে কোনো দুর্দিনে উপযুক্ত ভূমিকা রাখতে দেশপ্রেমিক নতুন প্রজন্ম নিশ্চয়ই সতত প্রস্তুত।
হে সমর্পিত অস্ত্র…
‘যদি কোনোদিন আসে দুর্দিন,
যেদিন ফুরাবে প্রেম অথবা প্রেম হবে না মানুষে মানুষে..
ভেঙ্গে সেই কালো কারাগার
আবার প্রণয় হবে তোমার আমার।’
কারণ, কারণ দেশটা যে আমার।
সে যে আমার জন্মভূমি ॥
সে যে আমার জন্মভূমি (ছয়)
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com