‘ভোলা পুড়, ভুলি পুড়, মশা মাছি বাইর-হ টাকা পয়সা ঘর-ল, সংসারের জঞ্জাল দূর-হ’

মোঃ আলাল মিয়া, নবীগঞ্জ থেকে ॥ ভোলাভুলি সংক্রান্তি বাঙালীর ঐতিহ্যবাহী একটি অনুষ্ঠান। কার্তিক মাসের শেষ দিন গ্রাম অঞ্চলে সন্ধ্যার দিকে ভোলাভুলি নামে একটি অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু এর বিস্তৃতি কমে এসেছে অনেক। বাংলার বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি অংশ এই ভোলাভুলি অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন। রবিবার কার্তিক মাসের শেষ দিন হওয়ায় নবীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয় ভোলাভুলি। বিশেষ করে নবীগঞ্জ উপজেলার হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এ অনুষ্ঠান বেশি পালন করতে দেখা যায়। বাঁশ ও খড় দিয়ে ভোলা তৈরি করা হয়। সন্ধ্যায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা একত্রিত হয়ে এই ভোলায় আগুন ধরিয়ে দেয়। নিমিষেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় ভোলা। ভোলায় আগুন ধরানোর সময় সবাই বলে- ‘ভোলা পুড়, ভুলি পুড়, মশা মাছি বাইর-হ, টাকা পয়সা ঘর-ল, সংসারের জঞ্জাল দূর-হ’। ভোলাভুলি’র অন্যতম আকর্ষণ ছিল- এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে গিয়ে কলা গাছের ডাল (ডাগুয়া) দিয়ে মানুষের ভোলা ছাড়ানো। এই ভোলা ছাড়ানোর সময় বলা হতো- ‘ভোলা ছাড়, ভুলি ছাড় বার মাইয়া পিছা ছাড়। ভাত খাইয়া লড়চড়, পানি খাইয়া পেট ভর।’ ‘খাইয়া না খাইয়া ফোল, হাজার টাকার মূল’। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি ধর্মীয় একটি অনুষ্ঠান মনে করা হলেও এটি হিন্দু-মুসলিম সবাই সমানভাবে পালন করে থাকেন। যদিও ভোলাভুলি নিয়ে হিন্দু ধর্মালম্বীদের মধ্যে মাসব্যাপী চলে আয়োজন। এ সময় প্রতিদিন সকালে ¯œান করে দেবতাকে ভোগ দেয়া হয়। আর মাসব্যাপী এই সংযমের শেষদিন ভোলা সংক্রান্তি হিসেবে এই ভোলাভুলি পালন করা হয়। কালের আবর্তে ভোলাভুলি এখন বিলুপ্তির পথে। তবে এখনো অনেক গ্রামে ভোলাভুলি অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। আবার কিছু কিছু অঞ্চলে বর্তমানে এই ভোলাভুলি সম্পর্কে লোকজন জানেই না।
এ ব্যাপারে নবীগঞ্জ উপজেলার জয়নগর গ্রামের বারেন্দ্র দাস জানান, অপেক্ষায় থাকতাম কখন ভোলাভুলি আসবে। ভোলাভুলি-তে সারাদিন ও মাঝ রাত পর্যন্ত আমরা অনেক আনন্দ করতাম। কিন্তু এখন আর আগের মতো ভোলাভুলি হয় না।
গয়াহরি গ্রামের রতু শীল বলেন, ভোলাভুলিতে প্রতিটি গ্রামে অনেক আনন্দ উৎসব হতো। অনেকে মাইক দিয়ে গান বাজনা করতেন। কিন্তু এখন শুধু সন্ধ্যার সময় ভোলা পুড়ানো ছাড়া আর কোন অনুষ্ঠান হতে দেখি না।
সুজাপুর গ্রামের বৃদ্ধা স্বপ্না দেব বলেন, ভোলাভুলির দিন আমরা গ্রামের সকল বান্ধবিরা মিলে টুপাটুপি ভাত রান্না করতাম ও মাঝ রাতে সবাই মিলে একসাথে আনন্দ করে খেতাম। সন্ধ্যায় ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা কলা গাছের ঢাল দিয়ে খেয়ালিদেরকে (নানা, নানী, দাদা, দাদী, ভাবি ইত্যাদি) ভোলা ছাড় ভুলি ছাড় বলে শরীরে মৃদু আঘাত করতো। শিশুরা পাট কাটিতে বা কাপড়ে কেরোসিন দিয়ে এ বাড়ি সে বাড়ি দৌড়ে বিভিন্ন ধরণের ছড়া বলত। ছড়ার মধ্যে ছিল- ‘ভালা আয়, বুরা যায়, মশা মাছি পোড়া যায়।’ ঐদিন (কার্তিক মাসের শেষ দিন) হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বাড়ি বাড়ি কার্তিক পূজা পালন করতেন। অনেকেই আবার বাড়ি ঘর সাজানোসহ ভাল খাবারের ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু আজ এর অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে।