কৃষি নির্ভর ভাটি অঞ্চলে তখন স্বর্ণযুগ। গোয়ালে গরু, হাওরে মাছ, গোলায় ধান আর সিন্দুকে টাকা ছিল অত্রাঞ্চলের তৎকালীন সুখের মাপকাঠি

ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব

শীতলক্ষ্যার জল মেঘনার জলের মত ততটা স্বচ্ছ নয়। মনে হল শহর বন্দরের নির্মম স্পর্শ নির্মল প্রকৃতির সাবলীল রূপকে যেন কালিমা লেপন শুরু করে দিয়েছে। শুধু পানি দূষণ নয়, বায়ু ও শব্দ দূষণের আধিক্যও ইন্দ্রিয়কে এড়িয়ে চলার সুযোগ ছিল না। নদীর উপরে নেই কোন গাংচিল, নেই আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ন্ত পাখির তেমন কিচিরমিচির। আছে নদীতীরে ইটের ভাটা আর ধানসেদ্ধ বয়লার মেশিনের ঘনঘন উপস্থিতি আর নিসৃত কালো ধূয়া। মাঝির মুখে নেই সেই ভাটিয়ালি আর আবেগে ভরপুর গানের অন্তরা। এখানে নেই হাছনরাজা, শেখ ভানু আর রাধারমণের উপস্থিতি। নেই জসীম উদ্দিন রচিত মরমী গানে আব্বাছ উদ্দিন আর আবদুল আলীমের হৃদয় উজার করা লম্বা টান।
হয়ত নদীতেও নেই তেমন নাব্যতা, নেই কোন উত্তাল তরঙ্গ। এখানে আছে যন্ত্রের সাথে যান্ত্রিকতা, তৎসঙ্গে গতির এক অসম প্রতিযোগিতা, হোক তা যন্ত্রের, জীবনের অথবা বিত্ত-ভৈববের।
আমরা প্রধান নদী থেকে বামদিকে ফাঁড়িপথে অনতিদূরে মদনগঞ্জ নৌকার ঘাটি তথা গাল্লার দিকে ঢুকতে থাকলাম। সন্ধ্যা সমাগত, শহরে বিজলি বাতি আর পাশেই শতশত নৌকায় হারিকেনের আলো। গাল্লায় হাজারো নৌকার সমাবেশ। প্রত্যকটা আড়তের আলাদা আলাদা নির্ধারিত স্থান। একেকটা আড়তের অধীনে পনের বিশটা করে নৌকা। আমাদেরটাও নোঙ্গর গাড়লো আষ্ট তহবিলের নির্দিষ্ট যায়গায়। কিছু কিছু পরিচিত লোকদের সাথে সবাই কুশলাদি বিনিময় করলেন। একই আড়তের অধীনস্থ ব্যবসায়ী বিধায় হয়ত কেউ কেউ পূর্ব পরিচিত। সাথে সাথে ধানের বাজারদর, লাভ-লোকসান নিয়েও কথাবার্তা চলছিল। বর্ষার এ সময়টাতে সাধারণত লোকসানের সম্ভাবনা থাকে না। দ্বিতীয়ত স্বাধীনতাত্তোর চুয়াত্তর পঁচাত্তর মন্বন্তর বা মঙ্গার কারণে ধানের বাজার অত্যধিক চড়া। সকলের মুখমন্ডলের বলিরেখায় ফুটে উঠা দিনভর ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠার পাশাপাশি অত্যধিক লাভের আশায় কেমন যেন এক আনন্দের ঢেউও ভেসে উঠছিল।
স্বাধীনতার পরপর বছর চার পাঁচ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটা অস্থিতিশীল ছিল। যেকোন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের পরবর্তী অবস্থা আসলে এমনটাই হয়। তার সাথে মজুতদার, মুনাফাখোরদের দৌরাত্ম্যতো ছিলই। সাথে ছিল দেশের সংকটময় মুহূর্তে দুষ্ট রাজনীতিকদের দেশের সম্পদের সিংহ চুরি। সুতরাং কৃত্রিম সংকটে ধান-চালের গগনচুম্বী দর সারা দেশব্যাপী অভাবনীয় দারিদ্র্যের সৃষ্টি হলেও ভাটি অঞ্চলের মানুষ তখন দারুণ সুখি। একটা বড় ইলিশ মাছ তখন বড়জোর বিশ টাকা, অথচ এক মণ ধান দুইশত পঞ্চাশ/পঁচাত্তর টাকা। অর্থাৎ এক মণ ধানে পনের বিশটা মাছ পাওয়া যেত। আর আজকাল একটা বড় ইলিশ কিনতে হলে প্রায় পাঁচমণ ধানের প্রয়োজন। সেলুকাস! কি বিচিত্র এই দেশ।
যা বলছিলাম, কৃষি নির্ভর ভাটি অঞ্চলে তখন স্বর্ণযুগ। সারা গাঁয়ে যেখানে একসময় পাঁচ-দশটা টিনের ঘর ছিল না সেখানে দু’বছরে ছনের ঘর পাঁচ দশটায় নেমে এসেছিল। ইট ইমারত বা পাকা ঘরের রেওয়াজ তখন তেমনটা ছিল না। অতএব গোয়ালে গরু, হাওরে মাছ, গোলায় ধান আর সিন্দুকে টাকা এই ছিল অত্রাঞ্চলের তৎকালীন সুখের মাপকাঠি। তাই ধানের বাজারেও চড়া লাভের প্রতিফলন সকল নৌকার শরীকদের চোখে মুখে ভেসে উঠছিল অবলীলায়।
আমার জীবনে বাড়ি থেকে মদনগঞ্জ তিনদিন দু’রাত তথা প্রায় ষাট ঘণ্টার এ নৌকা ভ্রমণ ষাটদিনের এক অনুপম অনুভূতির স্পন্দন তৈরি করে রেখেছে। এ ষাট বছর বয়সে দেশ-বিদেশের অনেক কৃত্রিম ঝলসানো আলো ঝলমল সৌন্দর্য নজরে পড়েছে। কিন্তু আমার এদেশ তথা আমার জন্মভূমির নয়নাভিরাম এ সৌন্দর্য, ষড় ঋতুর প্রকৃতিরঞ্জন লীলাখেলা যে আর কোথাও নেই। মন খুলে কথা বলা আর গান গাওয়ার এ মধুর ভাষা যে আর কোথাও নেই। নেই মায়ের ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য আত্মাহুতির এমন ইতিহাস বিশ্বের অন্য কোথাও। নেই মাত্র ন’টি মাসে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার এমনতর বিশ্বের কোথাও গৌরবোজ্জ্বল কোন ইতিহাস।
তাইতো চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে,

“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি”।
বলতে ইচ্ছে হয়,
“রূপসার ঘোলা জলে কিশোর এক সাদা
ছেঁড়া পালে
ডিঙ্গা বায়; রাঙ্গা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে
আসিতেছে নীড়ে
দেখিবে ধবল বক, আমাকেই পাবে তুমি ইহাদের
ভীড়ে।”