ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
দু’দিনের চলমান সফর মনে হচ্ছিল যেন দু’সপ্তাহ হয়ে গেল। আসলে প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগের উপলব্ধি সময়কে দীর্ঘায়িত করে তুলে। শুধু আনন্দ বা সুখানুভূতি নয়, দুঃখ ও বিষাদের যোগফলও জীবনের অনুভূতিকে নিশ্চয় অনেক বড় করে। হয়ত এটাই জীবনানুভূতি, এটাই স্মৃতি, এটাই আয়ু। হুম, সুখ দুঃখের এ যোগফলই হল অতীত, বেঁচে থাকার প্রেরণা, ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনার ভিত্তি। একসময়ে এর রোমন্থনই হয়ত শোক বা সুখস্মৃতি। হয়তো এরই অপর নাম নস্টালজিয়া।
খাওয়াদাওয়ার পর দরছ ভাই বললেন আজ বাজারে পালাগানের আসর বসবে, যা সবার জন্য উন্মুক্ত। চাচার নিকট যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। দরছ ভাই সহ আরো দু’জনকে সঙ্গে দিলেন। সাবধান করে দিলেন, এধরনের অনুষ্ঠানে অনেক সময় গন্ডগোল হয়। রাত ন’টায় আসর শুরু হল। লাল-হলুদ পর্দায় সাজানো স্টেজ, উন্মুক্ত সম্মুখভাগ, তিলধারনের ঠাঁই নেই। স্টেজের দু’পাশে হ্যাজাক লাইট। আমরা এককোণে দাঁড়িয়ে রইলাম। একে একে দু’জন শিল্পী আসলেন। একজন ঢোলা প্যান্ট ও শার্ট পরিহিত বেহালা হাতে, অন্যজন লম্বা পাঞ্জাবী সমেত লুঙ্গি পরা ঝাকড়া চুল, হাতে দোতারা। গলায় উত্তরীয় মত গলা বেস্টনি। স্টেজে উঠেই উনারা একে একে নিজেদের যন্ত্র বাজিয়ে মনে হল সবাইকে অভিবাদন জানালেন। দর্শক প্রতিউত্তর জানালেন করতালির মাধ্যমে।
শুরু হল মুর্শিদি ও বিচ্ছেদী। সুমধুর দোতারার আওয়াজে দর্শকদের পিনপতন নিরবতা ছিল মনে রাখার মত। ঝাকড়া চুলে নাড়া দিয়ে দোতারা বাদক মুর্শিদি গানে ডাক দিলেন। পরবর্তী গানে টান দিলেন বেহালাবাদক। গান শেষে চারণকবির মত ছন্দে ছন্দে মারিফতি প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন অন্য পক্ষকে। প্রশ্নোত্তরের ফাঁকে ফাঁকে গান। উত্তর সঠিক না হলে কটাক্ষ করে স্থানীয় ভাষায় ছন্দ মিলিয়ে আক্রমণ। দর্শকশ্রোতা দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেলেন। দেশীয় সংস্কৃতির দোতারার সুমধুর আওয়াজ আর আবেগী কণ্ঠের নিকট মনে হল ভিনদেশি ভায়োলিন আর পোষাক জনসমর্থনে হেরে যাচ্ছিল। অতি উৎসাহীজন পাঁচ, দশ, পঞ্চাশ টাকার নোট সেফটিপিন দিয়ে যার যার পছন্দের শিল্পীকে উনাদের জামায় আটকিয়ে দিচ্ছিলেন।
ছোটবেলা দু’একটা পালাগান দেখার সুযোগ হলেও ওইদিনের মত নিবিড়ভাবে স্থানীয় ভাষায় গ্রামীণ ধাছে স্বরচিত গান, মাঝে মাঝে হৃদয়স্পর্শী মুর্শিদি আর বিচ্ছেদী এ কৈশোরের বয়োঃসন্ধিক্ষণে গভীরভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ ইতিপূর্বে হয়নি। বিশেষ করে দোতারায় এত আবেগ ফুটে উঠতে পারে আগে জানা ছিল না। এইতো হল যুগ যুগ ধরে চলে আসা আবহমান বাংলার স্বকীয়তা। এইতো সেই লালন, শেখ ভানু, হাছনরাজা আর রাধা রমণের ভাটি বাংলার বহমান সংস্কৃতি। পল্লীকবি জসীম উদ্দিনের ‘বন্ধু বিনোদিয়ারে প্রাণ বিনোদিয়া’র বাংলাদেশ।
রাত প্রায় বারোটায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও নৌকায় ফিরতে হল। চাচা ছইয়ের উপর বসে আছেন। বিছানায় শুয়ে পালাগান, প্রশ্ন, প্রতিউত্তর এবং ছন্দের মিল নিয়ে অংক কষতে ছিলাম। মনে হচ্ছিল এ আর তেমন কি, আমিও পারব। কবি জসীম উদ্দিনত পালাগান শুনেই কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। একদিন হয়ে উঠেছিলেন পল্লীকবি জসীম উদ্দিন। আবার পদার্থ বিদ্যার সূত্র, রসায়নের সমীকরণ এবং বায়োলজির দাঁতভাঙ্গা ল্যাটিন ও গ্রীক শব্দ, দু’মাস পর পরীক্ষার ফল প্রকাশের টেনশন সবকিছু যেন এলোমেলো করে দিচ্ছিল। মধ্যরাতে উজ্জ্বল আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ, শত সহ¯্র আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রপূঞ্জ, বিস্তৃত ছায়পথ সব যেন চিন্তার জগতকে তালগোল পাকিয়ে ফেলছিল। এমনি করে কখন যে নিদ্রাপরী এসে ভর করেছিল একটুও টের পাইনি।
চলবে…