তনু সাংবাদিকদের কাছে বললেন হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র পদে উপ-নির্বাচনে জি কে গউছ নৌকাকে বিজয়ী করতে কাজ করেছেন
স্টাফ রিপোর্টার ॥ হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র পদে উপ-নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ও জেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক ইসলাম তরফদার তনু সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছেন জেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক ও সাবেক মেয়র জি কে গউছ অনৈতিক সুবিধা নিয়ে নৌকার পক্ষে কাজ করেছেন। এ ব্যাপারে দলের হাই কমান্ডের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করবেন।
বুধবার দুপুরে হবিগঞ্জ শহরের ফুড ভিলেজ রেস্টুরেন্টে সাবেক ছাত্রনেতা ইসলাম তরফদার তনু লিখিত বক্তব্যে বলেন, আমি ৩৫ বছর যাবত রাজপথে থেকে রাজনীতি করে আসছি। জেলা ছাত্রদলের দুইবার সভাপতি এবং দুইবার সাধারণ সম্পাদক এবং শ্রমিকদলের দুইবার সভাপতি এবং দুইবার সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করার পর জেলা বিএনপির বিগত দুই কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। দলকে সংগঠিত করতে এবং এরশাদ ও সরকার বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে শতাধিক মামলার আসামী হয়েছি। রিমান্ড ও ডিটেনশনসহ কারাভোগ করেছি। ২০১৫ সালের উপ-নির্বাচনে তিনি হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র পদে নির্বাচন করতে চাইলে খালেদা জিয়ার নির্দেশে তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহার করে কিবরিয়া হত্যা মামলার কারাগারে থাকা আসামী জি কে গউছের পক্ষে কাজ করেন এবং তাকে বিজয়ী করেন। কিন্তু এবার তিনি নির্বাচন করলে জি কে গউছ সকল নেতাকর্মীদেরকে তার পক্ষে কাজ না করার নির্দেশ দিয়ে নৌকাকে বিজয়ী করতে কাজ করেন।
লিখিত বক্তব্যে ইসলাম তরফদার তনু আরও বলেন, স্থানীয় নির্বাচনে দলের প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য সকল দলের নেতাকর্মীরা মাঠে ময়দানে কাজ করেন। কিন্তু হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র পদে উপ-নির্বাচনে আমি বিএনপির সমর্থিত একমাত্র প্রার্থী হওয়ার পরও জি কে গউছ আমার পক্ষে কাজ করেননি। এমনকি তার বলয়ে থাকা কোন নেতাকর্মীও আমার পক্ষে মাঠে নামেনি। তার নিজের কেন্দ্র গাউছিয়া সুন্নিয়া একাডেমীতে আমার ভোট নেই বললেই চলে। বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত কেন্দ্রগুলিতেও মোবাইল ফোন মার্কা অপ্রত্যাশিত ও অকল্পনীয় কম ভোট পায়। পাশাপাশি নৌকা মার্কা বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়। কার সহযোগিতায় নৌকার বিজয় হয়েছে এটা হবিগঞ্জবাসী ভালোভাবেই অবগত আছেন। জি কে গউছ সব সময় ত্যাগী নেতাকর্মীদেরকে মূল্যায়ন না করে তার নিজস্ব ও আজ্ঞাবহ কিছু লোক দিয়ে দলের নেতৃত্ব সামরিক কায়দায় চালিয়ে যায়। আর নিজে একাই সকল ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে রাখে। তাই তার বিপদের সময় আমি যে সহযোগিতা করেছি তা মনে না রেখে শুধু আমারই ক্ষতি করেনি, এই নির্বাচনে হবিগঞ্জে বিএনপিকেও চরম ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে সচেতন মহল মনে করেন।
ইসলাম তরফদার তনু বলেন, জি কে গউছ সব কিছু একাই পেতে চায়। দলের আর কেউ জন নেতা হউক এবং দল সু-সংগঠিত হউক এটা সে কখনও চায়নি। তার কাছে দলের চেয়ে নিজের ব্যক্তি স্বার্থই বড়। সে নিজেই দলের বড় পদ দখল করে রাখতে চায়। নিজে এমপি হতে চায়, আবার নিজেই মেয়র হতে চায়। অন্য কেউ সেদিকে এগিয়ে আসুক সে তা চায় না। আগামীতে যাতে আবারও সে পৌরসভার মেয়র পদে নির্বাচন করতে পারে তার জন্য বিএনপির প্রার্থীর যাতে চরম ভরাডুবি হয় তার জন্য সে এই জঘন্য দল বিরোধী কাজ করেছে। কিন্তু এবারের উপ-নির্বাচনে তার এই আচরণে শুধু আমি নই, বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরাও ক্ষুদ্ধ। স্বৈরাচারী, ফ্যাসিবাদী মনমানসিকতা সম্পন্ন জি কে গউছের এই জঘন্য দল বিরোধী কর্মকান্ডের জন্য আমি যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে দলীয়ভাবে তাহার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদনও জানাব। আর এই প্রতিকূল পরিবেশেও যে সকল নেতাকর্মী আমার পাশে থেকেছেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। পাশাপাশি বলতে চাই যত ষড়যন্ত্রই হউক আমাকে এবং হবিগঞ্জে বিএনপির অগ্রযাত্রাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না। আমি রাজপথের সৈনিক। রাজপথে থেকেই সবকিছু মোকাবেলা করব এবং ভবিষ্যতে যাতে হবিগঞ্জ পৌরবাসীর সেবা করতে পারি তার জন্য আমি মাঠেই থাকব, ইনশাল্লাহ। হবিগঞ্জ পৌরসভায় আমি মেয়র নির্বাচিত হতে না পারলেও জনগনের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করব এই প্রতিশ্রতি রইল।
নিজের রাজনৈতিক কর্মকান্ড সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইসলাম তরফদার তনু বলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন বাংলাদেশে ছাত্রদল নামে নবীন একটি সংগঠন করেছিলেন তার কিছুদিন পর থেকেই আমি একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসাবে এই সংগঠনের সাথে জড়িত হই। শুধু তাই নয়, হবিগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় ছাত্রদলকে ছড়িয়ে দিয়ে জেলার প্রধান ছাত্র সংগঠনে রূপান্তর করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করি। জেলার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ সরকারী বৃন্দাবন কলেজ ছাত্র সংসদে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ ও জাসদ ছাত্রলীগের আধিপত্য ভেঙ্গে দিয়ে ছাত্রদলের অবস্থান সু-সংহত করতে সচেষ্ট হই। আমি জেলা ছাত্রদলের দুই বারের সাধারণ সম্পাদক ও দুইবারের সভাপতি নির্বাচিত হই। আমার এই সাংগঠনিক দক্ষতার জন্য দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আমাকে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলেরও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে মনোনীত করেছিলেন। ছাত্রদলকে সু-সংগঠিত করে পরে আমি হবিগঞ্জ জেলায় শ্রমিক দলকে সংগঠিত করার দায়িত্ব নেই। জেলা শ্রমিক দলের আমি দুই বার সাধারণ সম্পাদক এবং দুই বার সভাপতির দায়িত্ব পালন করি। রাজনীতির ধারাবাহিকতায় ছাত্রনেতা থেকে ধাপে ধাপে আমি মূল সংগঠন জেলা বিএনপির বিগত দুই কমিটির আমি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করি এবং বর্তমান কমিটির যুগ্ম আহবায়ক মনোনীত হই। আমি ছাত্ররাজনীতি করার সময় স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে শতাধিক মামলার আসামী হয়ে হুলিয়া নিয়েও রাজপথে ছিলাম। পরে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে আমি রিমান্ড, ডিটেনশনসহ দীর্ঘদিন কারাভোগ করি। আমাকে দমানোর জন্য কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে আমাকে স্থানান্তর করা হলেও আমি দলের নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হয়ে রাজপথে থেকেই রাজনীতি করে আসছি। বর্তমান অবৈধ সরকারের প্রথম মেয়াদে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর থেকে তাকে জীবিত ও অক্ষত পাওয়ার আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে আমার বিরুদ্ধে দ্রুত বিচারে একটি মামলা সহ তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। জি কে গউছ যখন কিবরিয়া হত্যা মামলায় চার্জশীটর্ভূক্ত আসামী ছিলেন কোর্টে হাজির হয়ে জামিন চায়। কোর্ট জামিন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে প্রেরণ করেন। তখন জি কে গউছের মুক্তি আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার কারণে আমার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। গত ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষের প্রার্থী জি কে গউছের পক্ষে কাজ করায় আমাকে চরমভাবে হয়রানী করা হয়।
ইসলাম তরফদার তনু বলেন, বিভিন্ন ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনীতি করলেও একজন প্রকৃত রাজনীতিবিদ জনগণের সেবা করার ব্রতেই রাজনীতি করেন। আর জনগণের সেবা করার জন্যই একজন রাজনীতিবিদ জনপ্রতিনিধি হতে চান। এটি রাজনীতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যেহেতু আমি তৃণমূল পর্যায় থেকে রাজনীতি করে আসছি এবং সর্বস্থরের জনগনের সাথে আমার সম্পর্ক তাই আমারও ইচ্ছা রয়েছে জনপ্রতিনিধি হওয়ার। আমার কর্মী ও সমর্থকরাও প্রত্যাশা করেন আমি যেন জনপ্রতিনিধি হয়ে জনগণের সেবা করতে পারি। সেই লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ৩০ শে ডিসেম্বর হবিগঞ্জ পৌরসভার যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে আমি প্রার্থী হয়েছিলাম। বিএনপি চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া উনার গুলশান কার্যালয়ে আমার প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে জি কে গউছের পক্ষে কাজ করার জন্যে নির্দেশ করেন এবং আগামী নির্বাচনে তোমাকে মূল্যায়ন করা হবে বলেন। এই সময় আমার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডাঃ সাখাওয়াত হাসান জীবন, বিএনপির সাবেক নির্বাহী কমিটির সদস্য সাবেক এমপি শাম্মী আক্তার শিপা, সাবেক এমপি শেখ সুজাত মিয়া সহ জেলা বিএনপির দায়িত্বশীল অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। আমি নেত্রীর নির্দেশ মেনে প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে জি কে গউছের নির্বাচনী কাজে অংশগ্রহণ করি। দলের সকল নেতাকর্মীদের আপ্রাণ প্রচেষ্টার ফলে জি কে গউছ কারাগারে থেকেও জয়লাভ করে। আমি যখন ২৪ জুনের উপ-নির্বাচনে প্রার্থীতা ঘোষণা দিয়ে ব্যাপক গণসংযোগ ও প্রচারণা শুরু করি তখন থেকেই জি কে গউছ বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মাঝে বিভ্রান্তিকর কথা বার্তা ছড়িয়ে দিতে থাকে। ফলে নেতাকর্মীরা আমার নির্বাচনী কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে নাই এবং কোন ধরণের সহযোগীতাও করে নাই। বিএনপির সর্ব্বোচ্চ হাইকমান্ড থেকে জি কে গউছ কে আমার নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করার নির্দেশ দেওয়ার পরেও সে কোন প্রকার সহযোগিতা করে নাই। সে এমন আচরণ শুরু করে যেন আমি তার শত্রু হয়েছি। কৌশলে সে আমার সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কে দুরত্ব সৃষ্টি করতে থাকে। আমি তার কাছে সহযোগিতা চাইলেও সে কোন ধরনের সহযোগিতা করেনি। বরং সে দলের সকল নেতাকর্মীকে নির্দেশ দেয় কেউ যাতে আমার পক্ষে কাজ না করে। শুধু তাই নয়, যে আওয়ামী লীগের জন্য আজ আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে আর তারুণ্যের অহংকার তারেক জিয়া নির্বাসনে, সেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীর নৌকাকে বিজয়ী করতে সে বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা নিয়ে কাজ করে। গোপনে নেতাকর্মীদেরকে নির্দেশ প্রদান করে নৌকায় ভোট দেয়ার জন্য।
প্রসঙ্গত, ২৪ জুন অনুষ্ঠিত হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র পদে উপ-নির্বাচনে ইসলাম তরফদার তনু বিএনপির প্রার্থী হিসাবে অংশ নিয়ে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। এর আগে তিন টার্ম এ পৌরসভায় মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন আলহাজ¦ জি কে গউছ। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে হবিগঞ্জ-৩ আসনে নির্বাচন করার জন্য গত ২৮ নভেম্বর পদত্যাগ করলে মেয়র পদটি শূন্য হয়।