হবিগঞ্জের হাওর এলাকার ফসল বাঁচাতে নতুন প্রযুক্তির টিউব বাঁধ প্রকল্প উদ্ভাবন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দুই বছর পূর্বে আগাম বন্যায় হবিগঞ্জ তথা হাওর এলাকার কৃষকের চোখের সামনে তলিয়ে গিয়েছিল পাকার অপেক্ষায় থাকা মাঠ ভর্তি ধান। প্রতিবছরই পাকা ধান তলিয়ে যাওয়ার চোখরাঙানি মোকাবেলা করতে হয় কৃষকদের। শুধু বিনিদ্র রজনী কৃষকদেরই কাটে না। হবিগঞ্জ শহরবাসীও খোয়াই নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে না ঘুমিয়ে রাত কাটান। তবে এই সমস্যার সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলামের একটি উদ্ভাবন এই সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। টিউব ইন এমবাংকমেন্ট বা টিউব বাঁধ হল এই উদ্ভাবিত বাঁধের নাম। তার এই উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসল রক্ষা ও নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করলে ব্যয় হবে কম। বাঁধ হবে টেকসই এবং ১শ বছরেও কিছুই হবে না।
নতুন এই উদ্ভাবনটি ইতোমধ্যে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সেরা উদ্ভাবন হিসাবে মনোনীত হয়েছে। গত ২৯ জুলাই এক পত্রে এটি নিশ্চিত করা হয়। শীঘ্রই হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলামকে সার্টিফিকেট ও পুরস্কার প্রদান করা হবে। পরবর্তিতে এই প্রকল্পকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় তার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। নতুন প্রযুক্তিতে বাঁধ নির্মাণ করা হবে জিও টেক্সটাইলের তৈরি টিউব দিয়ে। যার ভিতর থাকবে বালু ভর্তি। জিও টেক্সটাইল এক ধরনের ফেব্রিক্স। যা ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ রিসাইকেল করে তৈরি পরিবেশ বান্ধব এক ধরনের উপাদান। এক সময় বিদেশ থেকে এই জিও ফেব্রিক্স আমদানী করা হত। বর্তমানে দেশের তিনটি ফ্যাক্টরি এই জিও টেক্সটাইল উৎপাদন করে। জিও টেক্সাটাইলের ভিতর দিয়ে পানি প্রবাহ হলেও মাটি বা বালু প্রবাহিত হয় না।
বাংলাদেশের মাটি নরম এবং নদীর বাঁধে বালুর পরিমাণ বেশী থাকায় অনেক চেষ্টা এবং হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরও প্রতি বছর ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। নতুন এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে দেশের বড় একটি সমস্যা সমাধানেরও সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
বুধবার জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বিকেজিসি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে জেলা পর্যায়ে ইনোভেশন শোকেসিং এর একটি স্টলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্ভাবনটি প্রদর্শন করা হয় এবং সকলের দৃষ্টি কাড়ে।
স্টলে থাকা এই প্রযুক্তির উদ্ভাবক হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলাম জানান, তার উদ্ভাবিত প্রযুক্তিটি হল যখন ফসল রক্ষা বাঁধ বা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্র্মাণ করা হবে তখন প্রথমেই জিও টেক্সটাইল ব্যবহার করে একটি টিউব তৈরি করতে হবে। ওই টিউব এর ভিতরে থাকবে বালি। টিউবটি স্থাপন করার পর এর উপর মাটি দিয়ে বাধ তৈরি করতে হবে। এভাবে বাধ তৈরি করলে বন্যা বা বৃষ্টির সময় বাধ তেমন একটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। শুধুমাত্র উপরের মাটি হালকা সরে যেতে পারে। সামান্য মেরামতেই বাধ সুরক্ষিত থাকবে। জিও টেক্সটাইল সূর্যের আলো লাগলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেহেতু টিউবটি মাটির নিচে থাকবে সেহেতু সেটি সূর্যের আলোর নাগাল পাবে না। এতে করে সেটি ১শ’ বছরেও কিছু হবে না।
তিনি আরও জানান, শুধু মাটি দিয়ে বাধ তৈরি করে তা সুরক্ষিত রাখা যায় না। তাই এই প্রযুক্তির আবিস্কার করা হয়েছে। এছাড়ও বর্তমান প্রযুক্তিতে একটি টেকসই বাধ নির্মাণে প্রতি মিটারে খরচ পড়ে ৫০ হাজার টাকা। নতুন এই প্রযুক্তিতে খরপ পড়বে প্রতি মিটারে মাত্র ৮ হাজার টাকা। বর্তমান প্রযুক্তির ছেয়ে নতুন প্রযুক্তির স্থায়িত্বও হবে বেশী। এমনিতে প্রতি বছরই বাধ মেরামত করতে গিয়ে প্রতি বছর সরকারের হাজার হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু প্রায় সময়ই শেষ রক্ষা হয় না। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করলে সামান্য অর্থে নিয়মিত মেরামত কাজ করলেই চলবে। এই প্রযুক্তি হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জসহ হাওর এলাকার এক কোটি জনগণকে সুরক্ষিত রাখবে বলে আশাবাদী তিনি।
কিভাবে এই উদ্ভাবন এর আগ্রহ পেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বছর দেড়েক পূর্বে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত সোনাই নদীর বাধ বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হলে জরুরি ভিত্তিতে মেরামত করা হয়। কিন্তু ২ মাস পর যখন আবার পানি আসে তখন বাঁধ আবারও ভেঙ্গে যায়। তখন আমি চিন্তা করি কিভাবে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা যায়। তখন আমি পরীক্ষামূলকভাবে আমার উদ্ভাবিত পদ্ধতি প্রয়োগ করে জিও টেক্সটাইল দিয়ে টিউব তৈরি করে মাধবপুর উপজেলার কোটানিয়া এলাকায় সোনাই নদীর ২০০ মিটার বাঁধ নির্মাণ করি। এতে হাতে নাতে ফল পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত ওই বাধের সামান্য ক্ষতি হয়নি। পরবর্তিতে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে এই প্রকল্পটিকে আমার উদ্ভাবন হিসাবে দাখিল করি। গত ২৯ জুলাই আমাকে পত্র দিয়ে জানানো হয়েছে আমার উদ্ভাবনটি সারা দেশের মাঝে সেরা হয়েছে। এখন এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশের সকল বাধ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে মন্ত্রণালয়। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করলে হবিগঞ্জ জেলায় থাকা ৪৬০ কিলোমিটার বাধ সুরক্ষিত রাখতে পারব।
তিনি বলেন, আমার এই সফলতার পিছনে আমার সহকর্মীদেরও অবদান আছে। সকলে মিলেই আমরা এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেছি। এই উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশ উপকৃত হলে আমি ধন্য হব।
হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই উদ্ভাবন দেখে আনন্দ প্রকাশ করেছেন হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবীর মুরাদ। তিনি বলেন, আমরা এমন উদ্ভাবন করব যাতে তা দেশের কাজে লাগে এবং অবশ্যই সেই উদ্ভাবন দেশের সেরা হয়। হবিগঞ্জের উদ্ভাবন দেশের সেরা হওয়ায় অন্যান্য বিভাগও ভাল কাজ করতে আগ্রহী হবে। এই উদ্ভাবনের বাইরেও হবিগঞ্জে আরও বেশ কয়েকটি উদ্ভাবন প্রশংসিত হয়েছিল। এর মাঝে রয়েছে অনলাইনে ভূমি কর নির্ধারণ।
বাংলাদেশ পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রোগ্রামার ইউসুফ হারুন জানান, মন্ত্রণালয়ে অনেকগুলো আইডিয়া জমা দিলেও হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডেরটি সেরা হয়েছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ৫ সদস্য এবং বিভিন্ন সংস্থার আরও ৫জন সদস্য মিলে একটি বোর্ড এই মনোনয়ন প্রদান করেছে। শীঘ্রই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাকে পুরস্কৃত করা হবে। তবে এই প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মোতাহার হোসেন বলেন, হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলাম পরীক্ষা করে নতুন প্রযুক্তি বের করেছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আমি আশা করছি এটি খুবই কার্যকর প্রযুক্তি হবে। তবে এটি আরও পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে। দেশের আরও বিভিন্ন স্থানে এর পরীক্ষা হবে। মনে হচ্ছে এটি ভালই কাজ করবে। তারপর যেখানে এই পদ্ধতি কার্যকর মনে হবে সেখানে তা কাজে লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু জিও টেক্সটাইলের টিউব মাটির নিচে থাকবে তাই ইদুর বা গাছের শিকর বাধের ক্ষতি করতে পারবে না। দেশে বাঁধ রক্ষায় এটি নতুন মাইল ফলক সৃষ্টি করতে পারে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জহিরুল হক শাকিল বলেন, বাংলাদেশে একটি গোষ্ঠী চায় না কোন সমস্যার স্থায়ী সমাধান হউক। বার বার কাজ করলে তাদের কমিশন পাওয়া বা ব্যবসা করার সুবিধা হয়। এই প্রযুক্তি নিয়ে যাতে এ ধরনের না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে।