এখন প্রয়োজন মাদক ক্যাসিনো খুন ধর্ষণ ঘুষ কালোবাজারি অর্থ পাচারসহ সকল অপকর্ম দমন করে সৎ ও মেধাবী লোকদের যথাস্থানে পুনর্বাসন

ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
এ নহে কাহিনী।
হ্যা, সত্য ঘটনাই বলব।
১৯৬৫ সাল। মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট টেন্কু আবদুর রহমান ব্রিটিশ কর্তৃক গঠিত ফেডারেশন থেকে অনুন্নত জেলে সম্প্রদায়ের দেশ সিঙ্গাপুরকে বের করে দিলেন। দেশটির প্রধান কিংকর্তব্যবিমূঢ় লি কুয়ান ইউ দেশের অন্ধকার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সাংবাদিক সম্মেলনে কেঁদে ফেললেন। কারণ তার দেশের জনগণ ফেডারেশন ত্যাগ করে স্বাধীনতা চাইছিলেন না। চাপিয়ে দেয়া স্বাধীনতাকে গ্রহণ করে লি কুয়ান মানে-অভিমানে দৃঢ় প্রত্যয়ে কোমর বাঁধলেন দেশ গড়ার। হাতে আছে ছোট্ট দেশের জনবহুল দরিদ্র জেলে সম্প্রদায়। নেই কোন প্রাকৃতিক সম্পদ। সমুদ্র বেষ্টিত কলহমান বহুজাতিক জনগোষ্ঠীকে নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলেন।
আইন ও অর্থনীতিতে দূরদর্শী বিচক্ষণ এই নেতা দেশের সৎ এবং মেধাবী লোকদের ডাকলেন। গুরুত্ব দিলেন সততার উপর। কড়া আইনের শাসন আরোপ করে আমলা এবং সরকারি কর্মচারীদের ভীত সন্ত্রস্ত রাখলেন। দুর্নীতিমুক্ত রাখতে বেতন বাড়িয়ে দিলেন বহুগুণে। দেশ থেকে দুর্নীতি শব্দটা হারিয়ে গেল চিরতরে ধীরে ধীরে।
ক্রমশ আধুনিক সমুদ্র বন্দর, শিল্পায়ন, এয়ার ট্র্যানজিটের সুবিধা সহ বিভিন্ন সংস্থার সদর দপ্তর স্থাপনের সুযোগ করে দিলেন কর কমিয়ে দিয়ে। মাথা প্রতি ৫০০ মার্কিন ডলার আয় নিয়ে পঁচিশ বছরে তা উন্নিত করলেন ৫৩, ০০০ (তিপ্পান্ন হাজার) ডলারে। আজ মাথা পিছু ৯০, ০০০ (নব্বই হাজার) মার্কিন ডলার।
তোষামোদি, চাটুকারিতা, পদলেহন আর চামচামির ঘাড় মটকে দিয়ে কলুষমুক্ত রাজনীতির গোড়াপত্তন করলেন। সাথে সাথে বহুজাতিক জনগোষ্ঠীর অধিকার সংরক্ষণ করে জাতিগত কোটা পদ্ধতির প্রবর্তন করলেন। সবাইকে ঘরবাড়ি তৈরি করে দিয়ে নাড়ি ও বাড়ির টানের মধ্যে দিয়ে এক অদৃশ্য দেশপ্রেম জাগিয়ে তুললেন। অর্থ পাচারের কোনরূপ সুযোগ রাখলেননা।
যদিও নির্ভেজাল গণতন্ত্র নিয়ে বিতর্ক আছে অনেক তথাপি সততা এবং আইনের শাসনের সুফল ও চোখ ধাঁধানো চমকভরা উন্নয়নের ঝলসানিতে সকল রাজনৈতিক ত্রুটি চাপা পড়ে গিয়েছিল।
আজ সমসাময়িক উন্নত বিশ্বের তুলনায় সিঙ্গাপুর চল্লিশ বছর এগিয়ে আছে। স্বপ্ন এখন বিশ্বের তুলনায় শতবছর এগিয়ে রাখার এবং এ পরিকল্পনায় কাজ চলছে অবিরাম।
স্বল্প পরিসরে এতগুলো কথা বলার একটাই কারণ। বিনা রক্তপাতে পাওয়া এমনকি চাপিয়ে দেয়া স্বাধীনতা শুধু নেতৃত্বের কারণে, সততার গুণে, কঠোর আইনের শাসনের প্রয়োগের ফলে সিঙ্গাপুর আজ বিশ্বের শুধু তৃতীয়তম ধনী দেশ নয় বরং পরিচ্ছন্ন একটা দেশ সর্বোতভাবে। এমনকি নীতি নৈতিকতায়ও পাশ্চাত্যের বেলেল্লাপনাকে পরিহার করে এক অনন্য মর্যাদার আসনে সমাসীন এ ক্ষুদ্র দেশটি যার মহানায়ক লি কুয়ান ইউ।
যা বলছিলাম, সিঙ্গাপুরের চেয়েও আমাদের দেশটা অনেক সম্ভাবনাময়ের দেশ ছিল। স্বাধীনতা লাভ করে সিঙ্গাপুর এখন আমাদের কল্পনা ও ধরাছোঁয়ার বাহিরে। আমাদের তেমন কিছু না থাকলেও ছিল এবং আছে কর্মক্ষম বিপুল জনশক্তি। আছে গ্যাস, কয়লা, মৎস্য সম্পদ, গার্মেন্টস ও ঔষধ শিল্প। আছে প্রায় কোটি প্রবাসী জনসম্পদ প্রেরিত অর্থে সমৃদ্ধ ব্যংক রিজার্ভ। আজ ঘরে ঘরে আছে কর্মক্ষম যুব শক্তি। আছে আন্তর্জাতিক মানের কয়েকটি সমুদ্র বন্দর তৈরির সুবর্ণ সুযোগ।
তাই আমি এখনো কিছুটা ধনাত্মক বা পজেটিভ ভাবনার অবলম্বন খুঁজি। কারণ, আমাদের আছে একটা মূল ভিত্তি বা ফাউন্ডেশন। অর্থাৎ এক নদী রক্ত ও আড়াই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে আমাদের আছে অগাধ দেশপ্রেম, যা নিয়ে দেশটা আমরা স্বাধীন করেছি। এ দেশপ্রেমকে পুঁজি করে এখন শুধু প্রয়োজন কঠোর হস্তে দুর্নীতিকে দমন করে সত্যিকারের আইনের শাসনের প্রনয়ণ ও প্রয়োগ। এখন প্রয়োজন মাদক, জুয়া, ক্যাসিনো, খুন, ধর্ষণ, ঘুষ, কালোবাজারি, অর্থ পাচার এসব অপকর্ম অত্যন্ত নির্মমভাবে দমন করে সৎ ও মেধাবী লোকদের যথাস্থানে পুনর্বাসনের। যারা তোষামোদি, চাটুকারিতা, দালালি ও তল্পিবহন করে জনগণের ঘামের বিনিময়ে অর্জিত অর্থ অবৈধভাবে লুণ্ঠন করে আজ রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন তাদের কালো তালিকাভুক্ত করে নির্মুল করা। যাদের বহির্বিশ্বের একাউন্টে শত শত বা হাজার কোটি টাকা রয়েছে তা জব্দ করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া। এদের সংখ্যা খুব একটা বেশি না হলেও এদের হাতে রয়েছে দেশের বিপুল পরিমাণ সম্পদ। কিন্তু মেকি দাপট, পেশী শক্তি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং আইনের কোমলতা ও ফাঁকফোকরের কারণেই দেশের শান্তিপ্রিয় সিংহভাগ জনগণ আজ এদের নিকট জিম্মি।
নিঃসন্দেহে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর গৃহিত অকুতোভয় নতুন পদক্ষেপ সাধুবাদ পাওয়ার দাবি রাখে। দেশের নব্বই ভাগ জনসাধারণ এতে পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। এটা একজন রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য বিরাট শক্তি ও নৈতিক বিজয়। আমরা এর সুন্দর ফলপ্রসূ এবং টেকসই পরিসমাপ্তি অবলোকন করতে চাই।
আবারও বলছি রক্তের দামে কেনা এ দেশটাকে আমাদেরকেই বাঁচাতে হবে। আমরা প্রবীণ, নবীন সকলের দায়িত্ব এখন আমাদের দেশটাকে দ্রুতগতিতে সম্মুখ পানে এগিয়ে নেয়া। কারণ…
এ যে আমার জন্মভূমি।
এ যে আমাদের জন্মভূমি ॥