...জীবন থেকে নেয়া...

ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’, ‘দি লেডি উইথ এন আরমাইন’ অথবা পাবলো পিকাসোর ‘থ্রি মিউজিসিয়ানস্’, ‘দি গীটারিস্ট’ আজ পৃথিবী বিখ্যাত তা শুধু তাদের হাতের কারসাজিতেই।
ইংরেজরা ঔপনিবেশিক শাসনামলে ‘মসলিন’ তৈরির তাঁতীদের বুড়ো আঙুল কেটে দিয়েছিল এ শিল্পকে বন্ধ করে কেবলমাত্র যান্ত্রিক শিল্পের উন্নয়নের জন্যই। শোনা যায় বাদশাহ শাহজাহানও তাজমহল তৈরির কারিগরদেরও তাই করতে চেয়েছিলেন শুধুমাত্র দ্বিতীয় আর একটি তাজমহল যাতে তৈরি না হয়।
পি.সি সরকার আর জুয়েল আইচরা আজ জগদ্বিখ্যাত কেবলমাত্র তাদের হাতের শৈল্পিক ব্যবহারের কারণেই।
চারু ও কারু শিল্পী এবং স্বর্ণকার তাদের সুক্ষ্ম অঙ্গুলি পরিচালনার মাধ্যমেই মানুষের মনোরঞ্জন করে থাকেন।
উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র সানাই, উস্তাদ আলী আকবর খাঁর সরদ তাও ঐ হাতের আঙ্গুলেরই কারসাজি।
সার্জনদের নির্দেশিকা অঙ্গুলিকে third eye বুব বা তৃতীয় নয়ন বলা হয়, কারণ বক্ষগহ্বর এবং পেটের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঙ্গ, শিরা উপশিরা না দেখেও সার্জন আন্দাজ করতে পারেন এবং অঙ্গুলি পরিচালনার মাধ্যমেই জটিল অপারেশন সম্পন্ন করেন।
ক্যারিওগ্রাফারের অঙ্গুলি নির্দেশে গান ও নাচের ছন্দ নিয়ন্ত্রণ হয়। অঙ্গুলির নির্দেশনায় স্বাধীনতার গোড়াপত্তন ঘটে। আর এ অঙ্গুলি নির্দেশনাতেই চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করেছিলেন আমাদের বিশ্বনবী (সঃ)।
মেডিকেল জীবনে অগ্রজ ডাক্তার মাশুক ভাইয়ের সুন্দর হাতের লিখার দিকে তাকিয়ে থাকতাম কারণ সেও তার হাতেরই মহিমা।
এবার আসল কথায় আসি। হাত এবং আঙ্গুলের গঠনশৈলী ও শৈল্পিক এনাটমি বিশ্লেষণ করা যাক…
সমস্ত শরীরের হাড়ের সংখ্যা মোট ২০৬টি, জানেন কি তন্মধ্যে দুই হাতেই রয়েছে ৫৪টি এবং তা হাতের এসব সুক্ষ্ম কর্মকান্ডের প্রয়োজনেইই।
দুই হাতের দ্রুত পরিচালনার নিমিত্তে রয়েছে ৬০টি মাংশপেশী।
মাংশপেশী সমূহের insertion বা নিস্পত্তি হয় tendon sheath এর মাধ্যমে যার শৈল্পিক গঠন এবং বিন্যাস খুবই সুন্দর এবং তাৎপর্যপূর্ণ।
ধমনী এবং শিরার জালিকা বিন্যাস (capillaries & venules), synovial sheath distribution অবাক করার মত। অনামিকা এবং মধ্যমা আঙ্গুলে সাইনোভিয়াল শিথ না থাকার কারণেই এই দু আঙ্গুলে prick করে রক্ত নেয়া হয় যাতে কোন প্রকার সংক্রমণ না হয়।
Index finger বা নির্দেশিকা আঙ্গুলে অপারেশনের সময়ে খোঁচা খেয়ে সংক্রমণ হওয়ার কারণে বিশ্বখ্যাত সার্জন হেমিলটন বেইলীর এ আঙ্গুলটি কেটে ফেলতে হয়েছিল। পরবর্তীতে একটা বিশেষ সার্জিকেল কোম্পানী উনার জন্য চার আঙ্গুল বিশিষ্ট গ্লাভ্স (gloves) তৈরি করে সরবরাহ করত।
আঙ্গুলের nerve endings বা স্নায়ুপ্রান্ত অত্যন্ত সংবেদনশীল। না দেখেও অনেককিছু স্পর্শ করে আন্দাজ করা সম্ভব যা অনেকটা ষষ্ঠেন্দ্রীয়ের মতই।
বুড়ো আঙ্গুলকে পরিচালনার জন্য ব্রেইনের যে স্নায়ুগুলি দায়ী (motor area 2) তার বিস্তৃতি অন্যান্য অঙ্গের আনুপাতিক এলাকার তুলনায় অনেক বেশি, যা এ আঙ্গুলের কার্যক্ষমতার গুরুত্বকেই নির্দেশ করে।
স্নায়ুবিহীন নখের উপস্থিতি কত গুরুত্বপূর্ণ একটু আন্দাজ করুন। তা কেবল সৌন্দর্য্যরে জন্যেই নয়, একবার কোন আঘাতে এটা পড়ে গেলে দিনে কতবার এখানে ব্যথা পাবেন তার ইয়ত্তা নেই, যা অনেকটা ভাঙ্গা পা গর্তে পড়ার মতই।
নখের ধরণ, আকার এবং রং দেখে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রোগ নির্ণয় করতে পারেন চিকিৎসকবৃন্দ।
আজ এ একবিংশ শতাব্দীতে finger print বা টিপসই বিষয়ক বিদ্যা (dactyligraphy) এক অলৌকিক বিষয় নয় কি! পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে অদ্যাবধি কারো আঙ্গুলের ছাপ কারো সাথে মিলার সুযোগ নেই। তাই জমিজমা আদান প্রদান, বায়োমেট্রি, ক্রিমিনোলজি এবং ইমিগ্রেশনে এর ভূমিকা অপরিসীম।
Dactyligraphy বিষয়ের শুরু ঊনবিংশ শতাব্দীতে, অথচ এর গুরুত্ব সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে আরো প্রায় হাজার দেড়েক বছর পূর্বে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে।
হাত এবং আঙ্গুলের অনেক অলৌকিক মহিমা হয়ত এখনো পুরোপুরি আমাদের জানা হয়নি।
সুতরাং আমরা সৃষ্টির কোন কোন মহিমাকে অস্বীকার করব ॥