আবুল কালাম আজাদ, চুনারুঘাট থেকে ॥ বিজিবি সদস্য ভাতিজার হাতে নির্মমভাবে নিহত খুন হওয়া চাচা দুলা মিয়ার বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। গতকাল বুধবার দুপুরে নিহত দুলা মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এলাকার মানুষজন লাশের অপেক্ষায় আছে। নতুন মানুষ দেখলেই তারা এগিয়ে আসছেন লাশের কোন খবর আছে কিনা জানতে। এলাকার যুবক জাহির মিয়া জানায়, ছাদেক মিয়ার পরিবার ঘটনার পর থেকেই পালিয়ে গেছে। বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছাদেক মিয়ার ঘরে তালা দেওয়া। গরু ছাগল সকল মালামাল নিয়ে তারা রাতের আধারে পালিয়ে গেছে। নিহতের স্ত্রী রেজু বেগম জানান, আমরা মৃত্যুর খবর পেয়েছি দুদিন আগে। কিন্তু লাশ না পাওয়ায় কিছু বলতে পারছি না। তিনি জানান, ছাদেক মিয়া আমার স্বামীকে এর আগে ৩টি মিথ্যা মামলা দিয়ে পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করায়। আমি গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় এসব মামলা তল্লাশী দিয়ে হাইকোর্টের মাধ্যমে স্বামীকে জামিন করিয়ে নিয়ে আসি।
নিহতের ভাই ইদু মিয়া পুলিশের সাথে ঢাকায় রয়েছেন বলেও তিনি জানান। নিহতের বড় ভাই জিতু মিয়া জানান, বসতভিটা দখলে নিতেই ছাদেক তার ভাইকে অপহরণ করে নিয়ে হত্যা করেছে। এর আগেও আমার ভাইকে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। আমি সামান্য জমি জমা বিক্রি করে আমার ভাইকে জেল থেকে জামিনে আনি। তিনি তার ভাই হত্যার বিচার চান।
এদিকে গত ১৪ জুলাই এ নিয়ে ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন নিহতের বাড়িতে গিয়ে তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন এবং একটি লাইভ করেন। এরপর থেকেই পুলিশও তৎপর হয়ে উঠে। ব্যারিস্টার সুমন নিহতের স্ত্রীকে তার স্বামীকে উদ্ধারে প্রয়োজনে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথাও লাইভে জানান। বিষয়টি তখন থেকেই এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি করে।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, উপজেলার শানখলা ইউনিয়নের পাট্টা শরীফ গ্রামের দরিদ্র কৃষক দুলা মিয়া তার প্রতিবেশি আব্দুল আলীর কাছ থেকে ৩ শতক বসতভিটাসহ ৭ শতক জমি কিনেছিলেন। কিন্তু এ জমি তার পাশের ঘরের আঃ রহিম নেওয়ার জন্য আদালতে একটি অগ্রকর মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে বিজ্ঞ আদালত মামলাটি দুলা মিয়ার পক্ষে রায় দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন আঃ রহিম মিয়ার ছেলে বিজিবির সদস্য (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি থেকে র্যাব-২এ প্রেষনে কর্মরত) ছাদেক মিয়া। তিনি জমিটি নিতে মরিয়া হয়ে উঠেন।
৭ শতক জমির মধ্যে ৪ শতক ধানি জমি আর ৩ শতক বসতভিটা। এর বাইরে দুলা মিয়ার আর কোন জমি জমা নাই। তিনি অন্যের জমি বর্গাচাষ করে ৫ মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে দিনাতিপাত করছিলেন।
বিজিবির সদস্য ছাদেক এর ঘরের পাশেই দুলা মিয়ার বসতভিটা ৩ শতক জমি দখলে নিতে ছাদেক নানা পরিকল্পনা করে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত ১৭ জুন সন্ধ্যায় দুলা মিয়া শাকির মোহাম্মদ বাজার থেকে বাড়ি ফেলার পথে তালতলা এলাকায় একটি সাদা মাইক্রোবাস (ঢাকা মেট্রো-১১-৮৭২২) করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে দিয়ে কয়েকজন লোক দুলা মিয়াকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এঘটনার পর রাতেই দুলা মিয়ার ছোট ভাই ইদু মিয়া বাদী হয়ে চুনারুঘাট থানায় বিজিবি সদস্য ছাদেক মিয়ার ভাই রফিক মিয়া, বোন জামাই আঃ মতিন, ভাগনিা রুমান মিয়া ও শাকিল মিয়াসহ গংকে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করেন।
এ মামলার সুত্র ধরে তদন্তে নামে চুনারুঘাট থানা পুলিশ। মামলা আইও নাজমুল হক মাইক্রোবাসের নং সংগ্রহ করে ভৈরবে টোল প্লাজার সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে গাড়িটি সনাক্ত ও উদ্ধার করেন। সে সূত্র ধরে মাইক্রোবাসের চালক ভোলা জেলার লালমোহন থানার টিটিয়া গ্রামের ইউসুফ সরদারকে ১৪ জুলাই ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী ঢাকার রায়ের বাজার থেকে গ্রেফতার করা হয় কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ থানার টামনিকোনাপাড়া গ্রামের মামুন মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। তারা উভয়েই ১৫ জুলাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ১৬ জুলাই গ্রেফতার করা হয় ভাড়াটিয়া খুনি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের জসিম উদ্দিন ও বরিশালের গৌরনদী উপজেলার গৌরবর্ধন গ্রামের শামীম সরদারকে। এর আগে ৩০ জুন সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছিল অহরণের অন্যতম সহযোগী ছাদেক মিয়ার ভাগনে আফরাজ মিয়াকে। তারা দুলা মিয়া হত্যার মামলা লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়। বিজিবি সদস্য ছাদেক মিয়ার সাথে তার সম্পর্ক। বিজিবি সদস্য ছাদেক মিয়া গত ১৫ জুন মামুন মিয়ার সাথে পরিকল্পনায় ১ লাখ টাকার চুক্তিতে দুলা মিয়াকে অপহরণ ও হত্যার চুক্তি করে। সেমতে গত ১৭ জুন দুলা মিয়াকে চুনারুঘাট থেকে অপহরণ করে ঢাকায় নিয়ে যায় মামুন মিয়া ও তার সহযোগিরা। অপহরণের সময় মামলা আসামী বিজিবি সদস্য ছাদেক মিয়ার ভাগিনা আফরাজ ও রুমান মিয়া সহযোগিতা করে বলেও তারা জানায়। অপহরণের পর দুলা মিয়াকে র্যাব-২ এর কার্যালয়ের সামনে নিয়ে যান মামুন ও তার সহযোগিরা। সেখানে ছাদেক মিয়া সম্পর্কে তার ভাতিজা দুলা মিয়াকে সিকদার মেডিকেলে পিছনে নিয়ে গিয়ে গলায় রশি পেছিয়ে হত্যার পর মামুন ও তার সহযোগিদের কাছে তার লাশ দিয়ে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দেন। পরে তার কথামতো মামুন গংরা তার লাশ বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়।
এদিকে চুনারুঘাট থানার দারোগা নাজমুল হক গাড়ি উদ্ধার ও মামুন মিয়া এবং ইউসুফ সর্দারকে আটকের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিজ্ঞাসাবাদে তারা বিজিবি সদস্য ছাদেক এর পরিকল্পনা ও ১ লাখ টাকার চুক্তিতে দুলা মিয়াকে হত্যার কথা স্বীকার করে। পরে তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করে। পরবর্তীতে এ ঘটনার কিলার সদস্য জসিম উদ্দিন ও শামীম মিয়াকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে। আসামী জসিম ও শামীম আদালতে পাঠানো হয়েছে।
চুনারুঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ শেখ নাজমুল হক জানান, এঘটনায় চুনারুঘাটে একটি ও ঢাকায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিলিং মিশনের বাকীদের ধরার চেষ্টা চলছে।
নিহত দুলা মিয়ার বাড়িতে শোকের মাতম
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com