মোহাম্মদ এ আজিজ
সমাজ বিবর্তনের পর থেকেই মানুষের মাঝে সমাজসেবার উদ্দেশ্যে সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলার অনুভূতি জাগে। আদিকালে মানুষ ছিল ধর্মে, বর্ণে, কৌমে, গোত্রে, গোষ্ঠীতে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন। তাদের মাঝে হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি, পারস্পরিক সংঘর্ষ ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। বলবানদের কাছে নিরীহরা ছিল জিম্মি। ধর্মীয় পুরোহিত ও সরদারতন্ত্রই ছিল সমাজের নিয়ন্ত্রক। সেকালেও প্রত্যেক সমাজে দুঃস্থ, নিরন্ন অসহায় মানুষের প্রতি কিছু মানুষের দরদ ও সহানুভূতি ছিল। সমাজে শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখা এবং পরস্পরের মাঝে সম্প্রীতি ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যবোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে মানবকল্যাণে জনদরদী মনীষীরা এগিয়ে আসেন। তারা স্ব-স্ব ধর্ম, বর্ণ, কৌম, গোত্র ও গোষ্ঠীভূক্ত লোকদের মাঝে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলে ঝগড়া বিবাদ, যুদ্ধবিগ্রহ, অভাব অনটনে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত মানুষের নিরাপত্তা ও সেবাদানের রেওয়াজ শুরু করেন। তারই ধারাবাহিকতায় দেশপ্রেমিক জনদরদী সমাজ সচেতন নাগরিকগণ দেশে দেশে গড়ে তোলেন সামাজিক সংগঠন। এমন কি পুঁজিবাদী উন্নয়নশীল দেশে কর্মরত প্রবাসীরা নিজেদের মাঝে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করে পরস্পরের মাঝে ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি গড়ে তুলে নানাবিধ সমস্যা সমাধান ও সাহায্য সহযোগিতার মানসে এবং স্বদেশে উন্নয়ন কর্মকান্ডে ভূমিকা রাখার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন নামে গড়ে তুলেছেন কমিউনিটি ও সামাজিক সংগঠন। প্রবাসীরা বিদেশ বৈভবে বর্ণবাদী সমস্যা ও নানাবিদ দূর্ভেদ্য বাধা ডিঙ্গিয়ে অনেক পথ অতিক্রম করেছেন। তারা অরাজনৈতিক সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে প্রবাসে ও স্বদেশে প্রবাসীদের সমস্যা সমাধান, বিভিন্ন দাবিদাওয়া আদায় সহ আর্ত-মানবতার সেবায় এবং স্বদেশে শিল্পান্নয়নে ভূমিকা রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তাদের দরদী মনের পরিচয় মিলে গরীব অসহায় মানুষের প্রতি দরদ-কৃপা-করুণা, দান-দক্ষিণা করে মানব সেবায় আত্মনিয়োগে ও স্বদেশ উন্নয়নে। আর্ত-মানবতার সেবা ও স্বদেশ উন্নয়নে আমাদের অগ্রজদের অনেক শ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। অনেকেই নিজেদের মূল্যবান সময়, ধনসম্পদ ও জীবন উৎসর্গ করেছেন।
সকলেরই জানা আছে যে আভিধানিকভাবে মানব সেবার অর্থ হলো সমাজে অসহায় মানবজাতির যতœ বা শুশ্রুষা করা। মায়ের গর্ভ হতে ভূমিষ্ট হওয়া নবজাতক শিশু থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধদেরকে পর্যন্ত সেবা-যতœ বা শুশ্রুষা করার প্রয়োজন হয়। তেমনিভাবে শান্তিপূর্ণ ও সুখী সমৃদ্ধশালী সমাজ গড়তে হলে সোসাইটি বা সমাজকেও সেবা-যতœ করতে হয়। এমনকি খেত-খামার, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানেরও সেবার প্রয়োজন হয়। সেবা-যতœ ছাড়া আপন সন্তানদেরকে যেমন মানুষ করা যায় না। তেমনি প্রয়োজনীয় শ্রম, সেবা-যতœ ছাড়া ক্ষেত খামার থেকে ভাল ফসলও তোলা যায় না। ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপায়িত করা সম্ভব হয় না। সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠনের পুঁজি হিসাবে জনসমর্থন অর্জন করতেও জনসেবার প্রয়োজন হয়। শুধু তাই নয় সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি লাভ করে পরকালে স্বর্গবাসী হওয়ার আশায় ধর্ম বিশ্বাসীগণ নিবিরচিত্তে সৃষ্টিকর্তার প্রার্থনা বা সেবায় মত্ব থাকেন। মূলতঃ মানুষ হচ্ছে ভোগবাদী। তাদের লোভ-লালসা, লিপ্সা, ভোগ-উপভোগ, আশা-আকাক্সক্ষার কোন সীমা বা শেষ নেই। ছল-চাতুরী, কৌশল ও ধূর্ততা তাদের অশেষ। তাই পাপের শাস্তি ও নিন্দার ভয় দেখিয়ে আসমানী কিতাব সমূহের মাধ্যমে ভালমন্দ চিহ্নিত করে মানুষকে আদেশ-নির্দেশ ও উপদেশ দেওয়া হয়েছে।
নবী-পয়গম্বর, সাধূ-অবতারগণ সমাজে নিরন্ন, নিঃস্ব, গরীব, অসহায়দেরকে অন্ন-বস্ত্রদানে ও লালন পালনের কথা বলে গেছেন। দরিদ্র-দুঃস্থ মানুষের প্রতি ধনবানদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের বাণী রেখে গেছেন। মারামারি, হানাহানি থেকে বিরত থেকে অসহায় মানুষের সেবায় একতাবদ্ধ হওয়ার উদ্দেশ্যেই মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) সামাজিক সংগঠন হিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সামাজিক জীবনে বিভিন্ন গোত্র-গোষ্ঠীর কাড়াকাড়ি, মারামারী, হানাহানী ও দ্বন্দ্বে নয় বরং সংযম, সহিষ্ণুতায় ও পরস্পর সহযোগিতার মাধ্যমে সুখে, শান্তিতে, স্বস্তিতে, নির্বিঘেœ, নিরাপদে সহাবস্থান করা যে সম্ভব সে বিষয়ে পবিত্র কোরআনের বাণী বাস্তবায়নের মাধ্যমে সম্ভব বলে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) সমগ্র মানব সমাজকে বলে গিয়েছেন। বারবার নবী-পয়গম্বরগণসহ জ্ঞানী-গুণী, মানবহিতৈষী শান্তিকামী শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিবর্গ দেশে-দেশে, কালে-কালে সমাজের স্বজনদেরকে ভাল হওয়ার, অপরের ভাল চাওয়ার, অন্যের উপকার করার এবং মানুষকে ক্ষমাপরায়ণ হতে, লোভ-লালসা থেকে বিরত থাকতে সর্বোপরি মানুষকে ভালবাসার জন্য আহ্বান করে গেছেন। গৌতম বৌদ্ধ তো কেবল মানুষের নয় বরং জগতের সব জীবের, সব প্রাণীরই বাঁচার এবং মানুষের সাথে সহ-অবস্থানের অধিকার দানের কথা বলে গেছেন। বর্তমানে যদিও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা তার বিঘোষিত নীতি লঙ্ঘন করে জীব হত্যা মহাপাপ নীতি বিসর্জন দিয়ে নিরীহ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধাদেরকে নির্বিচারে অত্যন্ত বর্বরোচিত ভাবে হত্যা করে চলেছে। নবী-পয়গম্বর ও সাধূ-অবতারগণের উল্লেখিত অমর বাণী সমূহের পথ ধরেই আধুনিককালে মানুষের মাঝে কানা, খোড়া, পঙ্গু, রুগ্ন, অনাথ, অসহায়, নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধার খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্মগত অধিকার বাস্তবায়নের পথ কার্লমার্কস পরিস্কার ভাবেই বলে গিয়েছেন। তারপরও ভোগবাদী মানুষের লোভ-লালসা, লিপ্সা, ভোগ-উপভোগকারী রাবণদের লঙ্কাকান্ড অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু নির্যাতিত, নিপীড়িত, অধিকার বঞ্চিত নিরন্ন অসহায় মানুষের প্রতি কিছু মানুষের দরদ ও সহানুভূতি সারা জগতেই ছিল এবং এখনো বিদ্যমান রয়েছে। সমাজে যখন কোন বিপর্যয় ঘটে তখন তাদের মানব দরদী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। তাদের সমাগম ঘটে প্যালেস্টাইনে, বার্মায়, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ও বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরনার্থী শিবির সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘটে যাওয়া মানবিক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত গণমানুষের মিছিলে। দুঃস্থ, নিরন্ন, ক্ষুধার্ত, স্বজন হারানো গৃহহারা মানুষের প্রতি সংবেদনশীল মানুষের দরদ, কৃপা, করুণা, দান-দাক্ষিণ্য নিয়ে এগিয়ে আসে মানবতার সেবায়। মা যেমন সন্তানকে ভালবাসে বলেই তার জন্য প্রাণ দিতে দ্বিধা করেন না, তেমনি যারা মানব সমাজকে ভালবাসে, দেশকে ভালবাসে তারাও দেশ ও মানুষের সেবার জন্য, মঙ্গলের জন্য নিজের জীবনের সুখ, শান্তি, আনন্দ, আরাম-আয়েস ও ধন সম্পদ বিসর্জন দিয়ে সর্বত্যাগী হয়। প্রয়োজনে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের ও দেশের সেবায় আত্মোৎসর্গ করে। যেমনটি করে মানবসেবায় আলোকিত নক্ষত্র হয়ে বেঁচে আছেন প্রেম ও করুণার দয়ার মূর্ত প্রতিমা মাদাম তেরেসা, ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল ও রেডক্রসের প্রতিষ্ঠাতা হেনরী ডুন্যান্ট।
এবার সুদূর প্রবাসে গড়ে উঠা সামাজিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা, ভূমিকা ও সমস্যা নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক। গরিবী হটানোর জন্য মাতৃভূমি ও আপনজন ছেড়ে কাজের সন্ধানে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, আরব আমিরাতসহ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছেন বাংলাদেশীরা। বিদেশ বৈভবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবাসীদের মাঝে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করে নিজ নিজ এলাকায় প্রাকৃতিক দূর্যোগাক্রান্ত নিঃস্ব অসহায় মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা এবং নিজেদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ করে মাতৃভূমিকে শিল্পোন্নয়ন করার উদ্দেশ্যে সামাজিক সংগঠনের গুরুত্ব অপরিসীম। কিছু কিছু সামাজিক সংগঠন বিভিন্ন এলাকায় আর্তমানবতার সেবায়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শিল্পোন্নয়নে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তবে সার্বিকভাবে সামাজিক সংগঠন গুলো সংকট ও সমস্যা মুক্ত নয়। যেমন জনকল্যাণ ও স্বদেশকে শিল্পোন্নয়ন করার অনুভূতি থেকে গঠিত অধিকাংশ সামাজিক সংগঠনগুলো দেশীয় অসুস্থ রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হতে পারছেনা। রাজনৈতিক দলের প্রতি অন্ধ অনুসারিরা অরাজনৈতিক সামাজিক সংগঠনে দেশীয় অসুস্থ রাজনীতির বিষবাষ্প ছড়ানোর চেষ্টায় কোন না কোনভাবে সম্পৃক্ত। রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের মাধ্যমে প্রবাসীদেরকে বহুধা বিভক্ত করে রাখার প্রবনতা বিদ্যমান। এদের অনেকেই নৈতিক চরিত্রে ও আদর্শিক প্রত্যয়ে শুদ্ধ নন বলে সমাজে কথা রয়েছে। তাদের মূল লক্ষ্য অন্যত্র। অনেকেই সমাজসেবার সুযোগ নিয়ে মান-সম্মান, যশ, দাপট, ক্ষমতা, প্রভাব প্রতিপত্তি, অর্থ-বিত্ত-বেসাত অর্জনে যেনতেন উপায়ে ধনী ও মানী হতে চান। কারন তাদের ধমনী শিরায় সুবিধাবাদের পাপ। মানুষের বা দেশের মঙ্গলের প্রতি এদের অঙ্গীকার ও দায়-দায়িত্ব প্রশ্নবিদ্ধ। আত্মপ্রচারণায় আসক্ত এই সকল তথাকথিত সমাজকর্মীগণ নিজেদের পরিচিতি লাভের জন্য বেপরোয়া। তাদের উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করা এবং স্থানীয় সরকার বা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন দল থেকে নমিনেশন ক্রয় করার ক্ষেত্র তৈরী করা। আশংকাজনকভাবে এই প্রতিযোগিতায় অনেকে আবার নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার কাজে লিপ্ত! নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য প্রকৃত সমাজ সেবকদেরকে ঠেকাতে নীতি, আদর্শ বিবর্জিত সংগঠন গঠনের প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে উঠেন। মানব সেবায় তাদের কোন অঙ্গীকার নেই। দেশকে ভালবাসা, সহনশীলতা, অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, পারস্পরিক সহযোগিতার গরজও এদের মাঝে অনুপস্থিত। অনেকেই সমাজকর্মে অনভিজ্ঞ, অযোগ্য হয়েও টাকা এবং পেশীশক্তির জোরে সংগঠনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ পদবী দখল করে নির্বাচনে দলীয় নমিনেশন প্রাপ্তির জন্য প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে উঠেন। কোন নীতি আদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান না হয়েও নিজেকে একজন দক্ষ, যোগ্য সমাজকর্মী এবং রাজনৈতিক বলে দাবি করেন। ক্ষমতার পরশে থাকতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে সে দলের স্তাবকে পরিণত হতে এদের বিবেকে বাঁধে না। দেশ থেকে কোন প্রভাবশালী ভিআইপি নেতা বা প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তার আগমনে এরা সরব হয়ে উঠে। ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে আত্মসম্মানবোধ, পৈত্রিক জান ও ধন সম্পদ লুটিয়ে দেয় তাদের চরণে। ভিআইপি বা প্রভাবশালীদের সাথে ফটো তোলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে এরা হয় তৃপ্ত। তল্পিবাহক হিসাবে প্রভাবশালীদের পিছনে পিছনে ঘুরে তদবির বাণিজ্যের সুযোগ নিয়ে অসদুপায়ে সুযোগ সুবিধা আদায় ও অর্থ সম্পদ অর্জন করা এদের লক্ষ্য। আমজনতা তথা নিরন্ন, নিঃস্ব, অসহায় মানুষের স্বার্থ ও কল্যাণ চেতনা তাদের মাঝে শূন্য। নৈতিকতা, আদর্শগত লক্ষ্য, আত্মমর্যাদাবোধ, বিবেক ও সমাজকর্মে যতটুকু আনুগত্য থাকা প্রয়োজন তা তাদের মাঝে অনুপস্থিত। ফলে দেশ ও বিদেশে মেকী সমাজকর্মীদের মাঝে কাড়াকাড়ি, মারামারি, হানাহানীর প্রতিযোগিতা বহমান। সমাজকর্মে অঙ্গীকারাবদ্ধ জনদরদী মানুষের ব্যাক্তিক, পারিবারিক ও সামাজিক মর্য্যাদা নিরাপত্তাহীন। দূর্বল, অসহায়, নিঃস্ব, নিরন্ন, দুঃস্থ, অজ্ঞ নিরক্ষর মানুষ হয় তাদের দ্বারা প্রতারিত, শোষিত ও বঞ্চিত। অসহায়দের জীবন ধনবান ও বলবান সামাজিক-রাজনৈতিক দ্রুজ্যধনদের হাতে জিম্মি। অন্যায়ের প্রতিবাদ, প্রতিকার করা এবং নিঃস্বার্থ ভাবে দুর্যোগাক্রান্ত অসহায় মানুষের সেবায় প্রকৃত জনদরদী সমাজসেবক বা রাজনীতিকের আকাল চলছে দেশ বিদেশে। ফলে প্রকৃত সমাজসেবা ও উন্নয়নমূলক কাজ থেকে সামাজিক সংগঠনসমূহের লক্ষ্য বিচ্যুতি ঘটে চলেছে যা প্রকৃত সমাজসেবক ও সামাজিক সংগঠনের জন্য অশনি সংকেত।
আরেকটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো যে সমাজকর্মকে শুধু দান-খায়রাত, আচার-অনুষ্ঠানের মাঝে সীমিত রাখা হচ্ছে। যা বাঞ্চনীয় নয়। মানবজাতির কল্যাণ ছাড়াও সমাজকর্মীদের যে আরো ব্যাপক দায়িত্ব রয়েছে সে ব্যাপারে অনেকেই অজ্ঞ। যেমন মানবাধিকার রক্ষা, বাক-স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, প্রবাসীদের ভোটাধিকার, জাতীয় পরিচয়পত্র, দ্বৈত নাগরিকত্ব অর্জন, বিমান বন্দরে হয়রানী বন্ধ, বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন, প্রকৃতি, পরিবেশ, নদ-নদী, বনজ সম্পদ, জলজ প্রাণী রক্ষাসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প ও খেলাধূলা সংক্রান্ত বিষয়ে যথাযথ ভূমিকা রাখার বিষয়ে সমাজকর্মীদের দায়িত্ব অপরিসীম। কিন্তু এসকল মৌলিক বিষয়ে মেকি সমাজকর্মীদের কোন প্রকার অঙ্গীকার বা ভূমিকা লক্ষ্য করা যায় না।
সামাজিক সংগঠনের চলমান সঙ্কট ও সমস্যা নিরসনে প্রথমেই ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে রাজনৈতিক মতভেদের উর্ধ্বে উঠে মানুষের প্রতি মায়া-মমতা, ভালবাসা, শ্রদ্ধাবোধ, মানুষের কল্যাণে ও মর্যাদাদানের জন্য সমাজকর্মীদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। দ্বিতীয়তঃ সমাজকর্মীদেরকে সেবকের যোগ্যতা অর্জনে বুদ্ধিগ্রাহ্য বাস্তব জ্ঞান ও মানুষের জীবন জীবিকা সম্বন্ধে বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং সততা থাকা প্রয়োজন। তৃতীয়তঃ প্রতিকূল অবস্থায়ও যে কোন পরিণামের ঝুঁকি নিয়ে এমন কি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নির্ভিকচিত্তে মানবকল্যাণে নিরলস ও অবিরামভাবে মানব সেবায় নিয়োজিত থাকার দৃঢ় অঙ্গীকার থাকতে হবে। অপর মানুষের মতামতের প্রতি, আচার-আচরণের প্রতি শ্রদ্ধার না হোক অন্ততঃ সহিষ্ণুতার দৃষ্টি প্রসারিত করার জন্য গণসচেতনতা বৃদ্ধি করার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সমাজ বিনির্মাণে অপরের সঙ্গে সমস্বার্থে সহযোগী হয়ে পরশীরূপে সদ্ভাবে ও শান্তিতে সহাবস্থানের পরিবেশ-পরিস্থিতির ক্ষেত্র তৈরি করার সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা। সমাজকর্মে বিরাজিত সকল প্রকার সমস্যা নিরসনে ঐক্যবদ্ধভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রকৃত জনদরদী, দেশপ্রেমিক সমাজকর্মী ও সংগঠন সমূহকে নিঃস্বার্থভাবে উদ্যোগী, নিষ্ঠা, সাহসী, ত্যাগপ্রবণ, সহিষ্ণু, প্রত্যয়ী, সংগ্রামী ও জনকল্যাণকামী হিসাবে তৈরি করার মাধ্যমে সমাজকর্মে বিদ্যমান সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।
লেখক: এম এ আজিজ
সমাজসেবক ও ফ্রিল্যান্স কালামিস্ট
লন্ডন, তারিখঃ ১১ জুলাই ২০১৯ইং