মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ চুনারুঘাটে মাত্র ৩ শতক জমির জন্য চাচাকে এলাকা থেকে অপহরণ করে ঢাকায় নিয়ে ভাড়াটে খুনি দ্বারা নৃশংসভাবে খুন করে র্যাবে কর্মরত বিজিবি সদস্য ছাদেক মিয়া। এ ঘটনায় শামীম সরদার (৩৬) ও জসিম উদ্দিন (৩১) নামে ২ ভাড়াটে খুনিসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গতকাল বুধবার হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা বিপিএম, পিপিএম-সেবা এ তথ্য নিশ্চিত করেন। সকাল ১১টায় হবিগঞ্জের সকল প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের সাথে পুলিশ সুপারের কনফারেন্স হলে অনুষ্ঠিত প্রেস ব্রিফিং-এ তিনি আরো জানান, দীর্ঘদিন ধরে শানখলা ইউনিয়নের পাট্টাশরীফ গ্রামের দুলা মিয়ার সাথে ৩ শতক জমি নিয়ে তার ভাতিজা একই গ্রামের আব্দুর রহিমের পুত্র বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের ল্যান্সনায়েক ছাদেক মিয়ার বিরোধ চলে আসছে। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার গ্রাম্য সালিশ হয়েছে। এমনকি তা মামলা মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ায়। মামলায় ছাদেক মিয়া পরাজিত হয়ে চাচার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। সে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে দেশের বিভিন্ন থানায় দুলা মিয়ার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। ওই মামলায় ওয়ারেন্ট ইস্যু করিয়ে তাকে গ্রেফতার করায়। প্রায় দেড় মাস জেল খেটে দুলা মিয়া জামিনে মুক্তি পান। এরপর প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে ছাদেক মিয়া তার চাচাকে চিরতরে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে ফন্দি আঁটে। সে এক লাখ টাকার বিনিময়ে একটি কিলার গ্রুপের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ওই কিলার গ্রুপটি একটি সাদা রংয়ের মাইক্রো ভাড়া করে তা নিয়ে চুনারুঘাটে আসে। গত ১৭ জুন সোমবার সন্ধ্যা প্রায় ৬টায় দুলা মিয়া নিজ বাড়ি পাট্টা শরীফ হতে টমটমে করে স্থানীয় শাকির মোহাম্মদ বাজারে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন। এ ঘটনায় নিখোঁজ দুলা মিয়ার ভাই ইদু মিয়া বাদী হয়ে ৩ জনকে আসামী করে চুনারুঘাট থানায় একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর ঘটনার রহস্য উদঘাটন ও অপহৃত দুলা মিয়াকে উদ্ধারে মাঠে নামে পুলিশ।
তদন্তের এক পর্যায়ে পুলিশ জানতে পারে ১৭ জুন একটি অপরিচিত সাদা মাইক্রোবাস পাট্টা শরীফ গ্রামে আসে। দুলা মিয়া শাকির মোহাম্মদ বাজারে যাওয়ার পথে টমটমটি মাইক্রোবাসের সামনে এলে ওই মাইক্রোবাসে থাকা কয়েকজন তাকে জোরপূর্বক মাইক্রোতে তুুলে নিয়ে যায়। ঘটনাটি দেখতে পেয়ে উৎসুক এক ব্যক্তি মোবাইল ফোনে মাইক্রোবাসের ছবি তুলে রাখে। পুলিশ ওই ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে তার কাছ থেকে মাইক্রোবাসের ছবি নিয়ে নতুন করে তদন্তে নামে। সংগৃহিত ছবিতে মাইক্রোবাসের নম্বর সঠিকভাবে দেখা না যাওয়ায় পুলিশ ভৈরব টোল প্লাজা থেকে সিসি টিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে চুনারুঘাট থেকে সংগৃহিত ছবির সাথে মিলিয়ে মাইক্রোবাস সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। ওই ছবি দেখে পুলিশ মাইক্রোবাসের চালক ও মালিককে সনাক্ত করে। এদিকে এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ৩০ জুন শ্রীমঙ্গল থেকে ছাদেকের ভাগ্নে মোঃ আফরাজ মিয়াকে পুলিশ গ্রেফতার করে। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ। আফরাজকে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ কোন তথ্য না পেয়ে মাইক্রোবাসের চালকের সন্ধানে নামে। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে ১৪ জুলাই ঢাকা থেকে অপহরণ ঘটনায় ব্যবহৃত মাইক্রোবাসটি উদ্ধার করে জব্দ করে পুলিশ। একই সাথে মাইক্রোর চালক মোঃ ইউসূফ সরদারকে গ্রেফতার করা হয়। সে ভোলা জেলার লাল মোহন থানার টিটিয়া গ্রামের মৃত আব্দুল আজিজের পুত্র। সে ঢাকার হাজারীবাগ থানার পশ্চিম ধানমন্ডি বড়ইখালীর আবুল ম্যানেজারের বাড়িতে ভাড়ায় বসবাস করে আসছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পারে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতারকৃত আসামী মোঃ আফরোজসহ ৮ জন মিলে দুলা মিয়াকে অপহরণ করে। তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে পুলিশ ঢাকার রায়ের বাজার এলাকা থেকে মোঃ মামুন মিয়া নামে আরো একজনকে গ্রেফতার করে। সে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ থানার টামনিকোনাপাড়া গ্রামের মোঃ লাল মিয়ার পুত্র। তাকে গ্রেফতারের পর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মামুন মিয়া জানায় চুনারুঘাটের পাট্টাশরিফ গ্রামের আঃ রহিমের পুত্র ছাদেক মিয়ার পরিকল্পনায় দুলা মিয়াকে অপহরণ করে ছাদেক, জামাল, শামীম এবং সে নিজে। পরে তারা সংঘবদ্ধভাবে দুলা মিয়াকে ঢাকার হাজারীবাগ থানার সিকদার মেডিকেলের পেছনে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে নিয়ে গলায় রশি পেছিয়ে হত্যা করে লাশ বস্তার ভিতরে ভরে পানিতে ফেলে দেয়।
গ্রেফতারকৃত ইউসূফ ও মামুনকে আদালতে সোপর্দ করা হলে গত ১৫ জুলাই তারা আদালতে চাঞ্চল্যকর ঘটনাটির বর্ণনাসহ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। এর সূত্র ধরে অপহরণ ও হত্যাকান্ডে জড়িত থাকায় ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম থানার দূর্গাপুর গ্রামের মৃত শেখেন্দর আলীর পুত্র মোঃ জসিম উদ্দিন ও বরিশালের গৌরনদী থানার গৌরবধন গ্রামের মোঃ তাজেম সরদারের পুত্র শামীম সরদারকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গতকাল গ্রেফতারকৃত জসিম উদ্দিন ও শামীম সরদারকে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করে পুলিশ সুপার এসব তথ্য জানান।
পুলিশ সুপার আরো জানান, গ্রেফতারকৃতরা স্বীকার করেছে দুলা মিয়াকে আইনের লোক পরিচয় দিয়ে একটি অটোরিক্সায় তুলে নেয়। পরে তাকে পানি খাওয়ানোর কথা বলে পানির সাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়ে সিকদার মেডিকেলের পেছনে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে নিয়ে গলায় রশি পেছিয়ে হত্যা করে লাশ বস্তার ভিতরে ভরে পানিতে ফেলে দেয়া হয়। ১৮ জুন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে বস্তায় মোড়ানো একটি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে অজ্ঞাত হিসেবে লাশটি ঢাকার জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। পুলিশ সুপার জানান, দুলা মিয়া হত্যা ঘটনায় জড়িত অন্যান্যদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। নিহত দুলা মিয়ার ৫ জন কন্যা সন্তান রয়েছে। ৪ জন বিবাহিত। ছোট মেয়ে রাশিদা প্রতিবন্ধি হওয়ায় তাকে নিয়েই বসবাস করতেন তিনি।
চাচা দুলা মিয়ার কাছ থেকে মাত্র ৩ শতক জমি নিতে না পেরে তাকে খুনের পরিকল্পনা করে বিজিবি সদস্য ছাদেক মিয়া ॥ পরিকল্পনা মোতাবেক লাখ টাকার বিনিময়ে ভাড়াটিয়া খুনিদের দিয়ে চাচাকে অপহরণ করে ঢাকায় নিয়ে হাজারীবাগ থানার সিকদার মেডিকেলের পেছনে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে নিয়ে গলায় রঁশি পেছিয়ে হত্যা করে লাশ বস্তার ভিতরে ভরে পানিতে ফেলে দেয় ভাতিজা ছাদেক ॥ হবিগঞ্জ পুলিশ রহস্য উদঘাটন করে এ খুনের ঘটনায় জড়িত ছাদেকসহ ৫ আসামীকে গ্রেফতার করে ॥ হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা ঘাতকদের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে সাংবাদিকদের কাছে খুনের লোমহর্ষক বর্ণনা দেন
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com