গ্রামবাংলা ও আমার ছেলেবেলা ০১

ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব

বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে (একান্ন থেকে ষাট সাল) অজপাড়া গাঁয়ে সাড়ে সাত মাস মায়ের গর্ভে বসবাসের পর অপরিপক্ক অবস্থায় তথা মাত্র ত্রিশ সপ্তাহে ভূমিষ্ট হয়ে প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকা এবং বেড়ে উঠা ছিল তৎকালীন সময়ে একরকম অলৌকিক ব্যাপার। কারণ শিশুমৃত্যুর হার তখন উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে যারপরনাই ছিল উদ্বেগজনক। অতঃপর পরিবারের সবাই নির্ঘুম শতরজনী কঠোর পরিশ্রম করে গ্রামীণ পদ্ধতিতে তিলে তিলে বড় করে তোলার মোহাচ্ছন্ন লম্বা গল্প দাদীর কাছ থেকে বহুবার শুনেছি।
আমার প্রজন্মে আমিই ছিলাম প্রথম, তাই মা-বাবার কাছে নাড়ী ছেঁড়া সোনার ধন হলেও প্রৌঢ় দাদা-দাদীর নিকট ছিলাম হিরের টুকরো। কারণ স্নেহ ভালবাসা নিচের দিকেই গড়ায়। তাই বাঁচিয়ে তোলার সকল প্রচেষ্টায় কোনরূপ কার্পণ্য ছিল না। তা এতদিন সম্যক উপলব্ধি করতে না পারলেও ইদানিং ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবের সাহচর্যে এসে এদের নাতি-নাতনিদের লালন পালন ও উজার-প্রাণ মায়া-মমতা শতভাগ উপভোগ ও উপলব্ধি করার সুযোগ হয়েছে। বহু কাঙ্খিত আল্লাহ প্রদত্ত স্বর্গীয় উপহার সদ্যপ্রসূত অসহায় এক মানব শিশুকে কেমন করে প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি দিন এবং রাত সযতেœ প্রতিপালন করতে হয়, পালা করে রাত জেগে কেমন করে তীক্ষè ও নিখুঁত অথচ স্নেহের পরশ মাখানো অনুভূতি দিয়ে ছ’দিন, ন’দিন, চল্লিশ দিন বিরতি ও বিরক্তিহীনভাবে লালন করতে হয় তা গভীরভাবে অনুধাবন করেছি।
মানুষ আশরাফুল মাখলুকাতের শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি হলেও সবচেয়ে অসহায়তম এক প্রাণী। সাপ ডিম থেকে ফুটেই ফনা তোলে, কচ্ছপছানা জন্মের পরপরই হেঁটে পানিতে নেমে যায়। মশক, মাছি, পিঁপড়েদের লালন পালনের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু মানবশিশুকে গড়ে তুলতে কি পরিমাণ শ্রম, অর্থ, সময় ও সহযোগিতার প্রয়োজন তা ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না।
একজন চিকিৎসক হিসেবে অনেক গর্ভবতী মায়ের চিকিৎসা ও আল্ট্রাসনো করেছি। একযুগ দেড়যুগ অপেক্ষার পর মাতৃ জঠরে সন্তানের আগমনে মায়ের আনন্দাশ্রুর বহমানধারা অনেক প্রত্যক্ষ করেছি। এইতো বছর কয়েক পূর্বে মাননীয় এক হুইপ মহোদয়ের এক শ্যালিকা বিবাহোত্তর এগার বছর অপেক্ষার পর সন্তান সম্ভবা হয়ে অধীর আগ্রহে আমার নিকট আমার খুবই ভক্ত হুইপ সাহেবের নির্দেশে অনেক দূর থেকে আল্ট্রাসনো করতে আসলেন। পরীক্ষার পর যখন জানালাম সন্তান সুস্থ আছে এবং ছেলে সন্তান, ভদ্রমহিলা তৎক্ষনাৎ আমাকে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলেন। আমি কিছুটা বিব্রতবোধ করলেও তাঁর আকুতি, আনন্দ আর ভবিষ্যত প্রাপ্তির সুখস্বপ্নকে শ্রদ্ধার চোখেই দেখেছি। আবেগাপ্লুুত হয়ে আমিও নির্বাক তাকিয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। যাওয়ার সময় উনার বাড়িতে বেড়ানোর আন্তরিক নিমন্ত্রণ ছিল একেবারেই নির্ভেজাল। তাই বলছিলাম, একজন শিশু তার মাতাপিতা, দাদা-দাদি এবং আত্মীয়-স্বজনদের কাছে এক বড় নিয়ামত, বংশের প্রদীপ, হয়তবা জাতিরও এক উজ্জ্বল ভবিষ্যত। অতএব বংশের প্রথম সন্তান হিসেবে আমার প্রতি একান্নবর্তী পরিবারের সকল সদস্যের আদর, দায়িত্ববোধ এবং স্বপ্নের আন্দাজ আমি ছোটবেলা থেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। তাও বুঝতে পেরেছিলাম দাদা-দাদি, চাচা ফুফুদের অতিশয় আদর আহ্লাদের কারণে আমার বাবা-মা অনেকটাই রিলাক্সড্ ছিলেন এবং এটুকুও উপলব্ধি করতে ভুল হয়নি সন্তানদের যোগ্যতর করে গড়ে তুলতে যোগ্য মাতাপিতা, দাদা-দাদি, চাচা ফুফু এবং মায়ের দিকের তথা নানাবাড়ির আত্মীয়-স্বজনদের সঠিক ভূমিকারও কোনই বিকল্প নেই।
অতএব প্রতিটি মানবশিশুই পরম করুণাময়ের নিকট হতে এক অমূল্য সম্পদ তথা অসাধারণ এক গিফ্ট!
যে কোন পরিবারের কাছে এক বড় ও অনন্য সম্পদ এবং নিয়ামতও বটে।
হয়ত তাই আমার দাদা-দাদি ও পরিবারের অন্যান্যরা যেকোন অসুখ-বিসুখ হলে অস্থির হয়ে পড়তেন। জেলা শহর থেকে প্রায় বিশ কিলো দূরে প্রত্যন্ত এ অঞ্চলে তখন তেমন কোন ডাক্তার বদ্যি ছিল না। তাবিজ-কবজ, ঝাড়-ফুকই ছিল প্রধান ভরসা। দাদির কাছ থেকে শুনতাম ঠান্ডা লাগলে বুকে তিল বা তিশির লেপ বা মালিশ, পেট ফুলে গেলে নীলের লেপ, কৃমি হলে বেঞ্জামিন পাতার রস এগুলোই ছিল মূখ্য চিকিৎসা। একটু বড় হয়ে যা দেখছি জ্বর হলে সাধারণ পল্লী চিকিৎসকের নিকট থেকে ছোট্ট বোতলে বিশেষ কায়দায় দাগকাটা সাদা কাগজ লাগানো লাল মিক্সার এবং লিভারের জন্য কালোমেঘ সিরাপ। কানে ব্যথা হলে দাদি কি যেন এক পাতার রস দিতেন। ছোট বাচ্চাদের নজর না লাগার জন্য কপালের একপাশে কালো টিপ, যার প্রচলন এখনো রয়ে গেছে। কোন রোগবালাই বুঝতে না পারলে উপরি বলে চালিয়ে দেয়া হত। সব শিশুদের মত আমারও গলায় এক ঝোটা তাবিজ ছিল। যতদূর মনে পড়ে সবক’টা তাবিজই চিবিয়ে চ্যাপ্টা করা ছিল। সিলেটের কিয়দংশ, কুমিল্লা, নোয়াখালী সহ ময়মনসিংহের অনেকাংশে এর প্রচলন এখনো বিদ্যমান।