তাহমিনা বেগম গিনি
ডায়রীর ছোট্ট একটি লেখা দিয়ে শুরু করছি- আজ থেকে ৪৮ বছর আগে যেমনটি লিখেছিলাম।
২রা পৌষ-১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সন। আজ আমি বসে আছি বগুড়ার ছোট্ট একটি সোনাফলা গ্রামে। আমার সামনে বিস্তীর্ণ সোনাঝরা ধান ক্ষেত, দূরে বাংলার সবুজ বনানী, তারই উপর পূব-আকাশ নবরাগে রাঙ্গিয়ে উদয় হচ্ছে-নতুন সূর্য। অনেক আশা, এক ভাষা, অনেক স্বপ্ন, অনেক আশ্বাস ভরা এ সূর্য আমার। শুধু আমার কেন, বাংলার সাড়ে সাত কোটি বাঙালির। বহু তাজা রক্ত, অমূল্য জীবন, বহু নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে পেয়েছি আমরা স্বাধীনতা। এক নদী তাজা রক্তে অবগাহন করে আজ আমরা স্বাধীন। বাংলাদেশের এই জন্মলগ্নে প্রতিজ্ঞা করছি যত রক্তের বিনিময়ে আমরা এ স্বাধীনতা পেয়েছি প্রয়োজন হলে এর চেয়ে বেশী রক্ত দিয়ে আমরা তা রক্ষা করবো। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল বিকাল ৫টা-১মি: ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক সেনাপতি লেঃ এ, এ, কে নিয়াজী তার সমস্ত সেনাবাহিনী সহ ভারতীয় সেনাপতি আরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং এই দুই পক্ষের মাঝে এক ঐতিহাসিক দলিল স্বাক্ষরিত হয়। ডায়রী লেখার অভ্যাস ছিল। আজো সেসব ডায়রী আমার কাছে আছে। আজ ৪৮ বছর পর অনেক কিছু মনে করতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস আমি এবং আমার পরিবার বগুড়া ছিলাম। দু’বার আমরা গৃহত্যাগ করেছিলাম। এপ্রিল মাসে যখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বগুড়া প্রবেশ করেছিল তখন, আর একবার ডিসেম্বর মাসে যখন সবাই বুঝে গিয়েছিল স্বাধীনতা দোর গোড়ায় অপেক্ষা করছে। তখন বগুড়ায় বিহারী, রাজাকার, জামাত, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সবাই মিলে মরণ কামড় দিতে শুরু করেছিল। বগুড়া স্বাধীন হয়েছিল ঊনিশ কিংবা বিশ ডিসেম্বর। বিশ ডিসেম্বর আমরা সপরিবারে স্বাধীন বগুড়ায় ফিরে আসি। এবার বাংলাদেশ ৪৮তম বিজয়দিবস পালন করছে। লাভ, লোকসানের হিসেব কষে লাভ নেই। পাওয়া, না পাওয়ার বেদনার চেয়ে সবচেয়ে বড় কথা, “আমরা স্বাধীন, স্বাধীন একটি দেশের নাগরিক।” এই বিজয়ের জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। ৩০ লক্ষ শহীদের বুকের রক্ত, দুই লক্ষ মা, বোনের সম্ভ্রমের রক্ত, আরো কত নির্যাতিত আজো বেঁচে আছেন সে সব চিহ্ন বক্ষে ধারণ করে, যুদ্ধাহত সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধারা এখনো যারা বেঁচে আছেন শারীরিক মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে- সবার ত্যাগের বিনিময়ে আজকের এই বিজয়। মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টি মাস মুক্তিযুদ্ধকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। যারা অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছেন তারা যেমন মুক্তিযোদ্ধা, ঠিক তেমনি যারা নিরুপায় হয়ে দেশ ছাড়তে পারেন নাই, প্রতিনিয়ত জীবন বাজি রেখে পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার যুদ্ধ করেছেন তারাও মুক্তিযোদ্ধা। ১ কোটি শরণার্থী কি অবর্ণনীয় অবস্থায় দিনরাত্রি পার করেছেন শরণার্থী শিবিরে। গুটি কয়েক রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি, জামাত ছাড়া সবাই ঘরে বাইরে নয়টি মাস যুদ্ধ করেছেন। অনেক কষ্টে পাওয়া আমাদের এই স্বাধীনতা। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন অনেক ক্ষেত্রেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যার নিরলস, অক্লান্ত, পরিশ্রম এবং নিখাদ দেশপ্রেমের স্বীকৃতি আজ বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে পেতে শুরু করেছে। কিন্তু সীমাহীন দুর্নীতি, আইন না মানার প্রবনতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের উন্নতিকে পিছু টানছে। বাংলাদেশ খুব সুন্দর একটি দেশ। দেশটিকে সবাই ভালবাসি। শুধু বিজয় দিবস নয়, প্রতিক্ষণ আমাদের স্মরণ করা উচিত সেই মহান ব্যক্তিকে, বাংলাদেশের জাতির পিতাকে যাকে ছাড়া বাংলাদেশের জন্ম হতো না। সেই জাতীয় চার নেতাকে যাদের দিক নির্দেশনা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ সুসংগঠিত হতো না, সেই ত্রিশ লক্ষ শহীদ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের যাদের অবর্ণনীয় কষ্ট ও ত্যাগ ছাড়া স্বাধীনতা লাভ সম্ভব ছিলো না এবং ২ লক্ষ মা বোন যারা দেশের জন্য অকাতরে নিজের সবকিছু বিলিয়েছেন এবং যেসব সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধারা আজো বেঁচে আছেন তাদের সবার প্রতি আমার সালাম এবং বিন¤্র শ্রদ্ধা।
আসুন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাই গেয়ে উঠি-
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।
অনেক ভালবাসি কারণ-
“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।”