সাইফুর রহমান কায়েস
সকালে বউয়ের ফোনেই ঘুম ভাঙ্গে। আমি একটু চমকিত হয়েছি তার ফোনে। বউ সাধারণত খুব দায়ে না পড়লে আমাকে বিরক্ত করে না। আজ একটু অবাকই হলাম তার ফোন পেয়ে। সে জানালো বাবা খুব অসুস্থ। দ্রুত যেতে হবে। আমি ভাতিজা দীপুকে ফোন দিয়ে জানলাম বাবা আর নেই। আমি তো শুনে জ্ঞান হারাবার যোগাড়। ধাতস্থ হতে অনেক সময় লেগেছে। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।
ঈদুল আযহার সময় উনার সাথে খেয়েছি, গল্প করেছি। আমাকে মাওলানা ভাসানীর প্রিয় রঙ- সফেদ পাঞ্জাবী উপহার দিয়েছিলেন। যেটি আমি নানা জায়গায় পরে যাই। ফুটানি করি। আমার অহংবোধকে তার দেয়া উপহার আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সদা হাসি মুখেই কথা বলতে পছন্দ করতেন। বাহিরে খুব রাগী হলেও ভেতরটা খুব নরম, শিশুর মতো কোমল ছিলো তার। আমি এমন মানুষ খুব কম দেখেছি যিনি বিরলপ্রজ। মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ, নিজের জীবনকে মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেছেন। অসহায় মানুষের পাশে থেকেছেন আজীবন। মানুষের সম্পদ বেড়েছে সরকারী দল করে আর উনার জাগতিক সম্পদ কমেছে। নিজের সম্পদ বেচে চিকিৎসার খরচ চালিয়েছেন, সাংসারিক খরচ চালিয়েছেন, নয় ছেলেমেয়েকে সুশিক্ষা দিয়েছেন। জাগতিক সম্পদ অর্জনের প্রতি তার কোনো লোভ ছিলো না, অন্যদেরকে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করেছেন কিন্তু নিজের জন্য কিছু করার চিন্তাকে রহিত করেই। তিনি ধনপ্রাচুর্য্যকে তুচ্ছজ্ঞান করেছেন বলেই প্রাণৈশ্বর্যে নিজেকে ঋদ্ধিমান করতে পেরেছেন। অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন।
মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ছিলো অকল্পনীয়। যে কারণে তিনি যে কোনো জটিল সমস্যা সমাধানে ব্রতী হতে অগ্রণীশোভন ভূমিকা রাখতে পেরেছেন। হবিগঞ্জ জেলার প্রতিটি মানুষ তাকে চিনতো একজন ন্যায়পরায়ণ, ষ্পষ্টভাষী, নির্লোভ, সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি ও মানুষ হিসাবে। যে কারণে তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন উল্টো ¯্রােতের মতো কঠিন পথে। কঠিনেরে বেসেছেন ভালো, আর এজন্যই তিনি বঞ্চিত হননি কোনোদিন মানবসেবার মতো অলাভজনক পেশায় থেকে।
তার দীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক একটি জীবন আমরা দেখি তার যাপিত জীবনের মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন সংগঠক হিসাবে দেশপ্রেমের তাড়নায়। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে কোনোদিনই এ থেকে ফায়দা হাসিলের চিন্তা থেকে নিজেকে খুব সচেতনভাবেই বিরত রাখতে পেরেছেন বলেই মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে কোনো সনদ গ্রহণ করেননি। করার ইচ্ছেও কোনোদিন অন্তরে লালন করেননি।
রাজনীতি করতে গিয়ে যেকোনো ধরনের প্রতিহিংসাকে তিনি ঘৃণার চোখে দেখতেন। কোনোরূপ বিভেদ তিনি চাইতেন না। সবাইকে সাথে নিয়ে চলতে চেয়েছেন। বিভক্তি নয়, ঐক্য ও সমতার ভিত্তিতে, অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে রাজনীতি করে গেছেন। মানুষ কখনো পদ পদবী ছাড়তে চায় না। কিন্তু তিনি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। নিজের পদ ছেড়ে দিয়ে অনুগামীকে পদে বসিয়ে উদারতার পরিচয় দিয়ে গেছেন। লোভের রাজনীতির বিপরীতে তিনি একারণে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকলেন। অনুকরণীয় আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন বলেই তিনি তার রাজনৈতিক সহকর্মী, অনুগামীদের কাছে চাচা, বড়ভাই হিসাবে সম্মানটুকু পেয়ে গেছেন।
আজকে যখন দেখি জনসাধারণ, আত্মীয়স্বজন, নানাধর্মের, নানাগোত্রের মানুষের পাশাপাশি নানামতের রাজনীতিবিদেরা তাকে শেষ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জানাতে সমবেত হন তখন সেটি আরো ষ্পষ্ট হয়ে উঠে আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের কাছে। হবিগঞ্জ জেলার একাধিক মাননীয় সংসদ সদস্য যথাক্রমে অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান, অ্যাডভোকেট আবু জাহির, শাহনেওয়াজ গাজী তার জানাজায় অংশ নিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তৃতা করেছেন। আরো এসেছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া চৌধুরী কেয়া। বিভিন্ন উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যানগণ অ্যাডভোকেট আলমগীর চৌধুরী, আব্দুল হাই, আবু তাহের, বিজ্ঞ পিপি সিরাজুল হক চৌধুরী, তরুণ রাজনীতিক নিজামুল হক মোস্তফা শহীদ রানাসহ আরো অনেকে উনার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এসেছিলেন অনেক মুক্তিযোদ্ধা, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
সকলের কাছেই তিনি ছিলেন একজন পিতৃবৎ অভিভাবক, মেন্টর। মানুষকে ভালোবেসে তিনি ভুল করেননি, সত্যের পথে চলে তিনি ভুল করেননি, লোভকে দমন করে তিনি কোনো ভুল করেননি, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাস করে তিনি যে কোনো ভুল করেননি, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি যে কোনো ভুল করেননি, নিজের সম্পদ না বাড়ানোর চিন্তা করে তিনি যে কোনো ভুল করেননি তার শেষযাত্রায় শোকার্ত মানুষের যে ঢল নেমেছিলো সেটিই তো তার প্রমাণ।
মানুষ যেখানে নিজের পেট ভরতে সংসদ সদস্যদের কাছে ধর্ণা দেয় তিনি সেখানে এর ব্যতিক্রম। মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজে, রাস্তার জন্য বরাদ্দ দিতে তিনি জনপ্রতিনিধিদেরকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, চাপে রেখেছেন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে বলেই অনেকে মনে করেন। এরকম মানুষেরা আসলেই বিরলপ্রজ। এরা বারে বারে পৃথিবীতে আসে না। এক শতাব্দী কিংবা এক সহ¯্রক পরে পরে আসে।
পরপারে ভালো থাকুন পিতা। স্যালুট আপনাকে।