ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
জীবনের প্রথম ছ’টি বছর মস্তিস্কের জন্য গঠনমূলক সময় তথা ‘ফরমেটিভ পিরিয়ড অব লাইফ’। কষ্টিপাথরে খোদাই করে রাখার মত সকল স্মৃতি, যেমন পারিবারিক আদর আহ্লাদ, হৈচৈ, মক্তব, স্কুল, বন্ধু বান্ধব, খেলার মাঠ সব মস্তিস্কের একটা অংশে আজীবন লালিত হতে থাকে। একান্নবর্তী পরিবারের বিশেষ করে দাদী ও চাচাদের নির্ভেজাল স্নেহের পরশ এবং সবচেয়ে বড়কথা মায়ের ও দাদীর আঁচলের সোঁদা গন্ধ আর নিরাপদ বেষ্টনী পেছনে ফেলে দশ বছর বয়সে হুট করে জনবিচ্ছিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ত্রিশ চল্লিশ কিলোমিটার দূরে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে চলে আসার কষ্ট কখনো ভোলা যায় না। মনে পড়ে প্রথমদিন ছোট চাচার হাত ধরে চলে আসার সময় বাড়ির ঘাটলায় পরিবারের সবার বিদায় সংবর্ধনা ও দাঁড়িয়ে থাকা মা এবং দাদীর আঁচলে চোখ মুছা আর আমার ফিরে ফিরে তাকিয়ে অশ্রু বিসর্জন একই সূতায় বাধা ছিল।
তৎকালীন সময়ে কিশোরী কন্যাকে যেমন করে চিরতরে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেয়ার সময় সবাই ভারাক্রান্ত হতেন আমার ব্যাপারটা তেমনি ছিল হয়ত এজন্য যে এরপর থেকে স্থায়ীভাবে আর বাড়ি ফেরা হয়নি অদ্যাবধি এবং সম্ভাবনাও নেই শুধুমাত্র একসময়ে প্রাণহীন দেহের প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশা ছাড়া তাও ভাগ্যের লিখনিতে থাকতে হবে বৈ কি।
যে বাড়িতে থাকতে হবে তা ছিল আমার বাবার মামার বন্ধুর বাড়ি। মামার বাড়ি থেকে অভিমান করে উনারই মামা তথা আমার দাদার বন্ধুর বাড়িতে চলে আসা আমার ছোট চাচা ছিলেন এ বাড়িতে সকলের আপনজন। আমারই স্কুলের ছাত্র হিসেবে ঐ স্কুলের শেষ পরীক্ষার পর চাচা আর এগুতে না পেরে হয়ত ভরসা করেছিলেন আমারই উপর। সদালাপি ও এক অনন্য আন্তরিক আচরণের অধিকারি চাচার ঐ পরিবারভুক্ত হওয়ার সাথে সাথে আমিও একজন বিবেচিত ভাল ছাত্র এবং শান্ত সুবোধ ছেলে ও নূতন মেহমান হিসেবে একটা জায়গা করে নিতে পেরেছিলাম সকলের অন্তরে স্বল্পদিনেই। ঘরের সবার নির্ভেজাল আদরের বদৌলতে হোমসিকনেস কাটিয়ে উঠতে দারুণ সহায়তা করেছিল। এক দু মাস পর পর বাবা এবং বিশেষ করে আমার বড় চাচা আসতেন দু’একদিনের জন্য। ছোটবেলা বাবার বকুনি খেয়েছি বার কয়েক কিন্তু বড় চাচার সামান্যতম কটু কথা বা দুর্ব্যবহার পাওয়ার কোন তিক্ত অভিজ্ঞতা আমার স্মৃতিতে নেই। বাবা এবং চাচাদের পরিকল্পিত এ লালন প্রক্রিয়া তৎসঙ্গে পড়াশুনার চাপে বাড়ি ও নাড়ির টানের দূরত্ব বাড়তেই ছিল দিনদিন।
আসল কথায় আসা যাক। লম্বা উঠোনের চতুর্দিকে পাঁচটি পরিবারের সকল ঘরের সদস্যই ছিল আমার একান্ত আপনজন। ছোট্টরা ছিল বিকালের খেলার সাথী। পুকুরে দলবেঁধে ডুবানো ঝাপানো থেকে শুরু করে গাছে উঠা, সীম বীচ কুঁড়িয়ে মুটি ধরে ভাঙ্গা হাঁড়ির টুকরো দিয়ে খেলার অনুপম স্মৃতিগুলো আজো সুখময় স্মৃতিপটে ভাস্বর। পুকুর পাড়ের কাঁঠাল গাছটা আজো মনে পড়ে রবি ঠাকুরের বলাইয়ের বৃক্ষ প্রেমের মতই। গোসলের সময় পুকুরে নামলে ডাক সম্বন্ধীয় ফুফু চাচীরা নাক মুখ পরিষ্কার করে ঘষেমেজে গোসল করিয়ে দিতেন সযতেœ মা দাদীর অবর্তমানে। পাশের ঘরে আশা নূতন বউ কেন জানি আদর করতেন তার অনাগত সন্তানের মত।
একটা কথা দারুণ মনে পড়ে। একদিন সহজ সরল সমবয়সী ও ছোট্টদের সাথে দুষ্টুুমি করতে গিয়ে বললাম বিকেলে স্কুল থেকে আসার সময় দূরে আমায় দেখা গেলে তোমরা কখনো তোমাদের কান ধরবানা, যদি ধর তাহলে আমার পেট ব্যথা শুরু হবে। ফেরার সময় দেখতাম আমাকে দেখা মাত্রই সবাই কান টেনে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি পেট ধরে বসে পড়ে এদেরকে ইশারায় অনুরোধ করতাম কান ছেড়ে দেয়ার জন্যে, ওরা আরো জোরে কান টেনে দাঁড়িয়ে থাকত। কথাটা চাচার কানে যাওয়ার পর বকুনি খেয়ে এর ভুল বুঝতে পেরেছিলাম।
সকলের সাথে গড়ে উঠা এ আন্তরিকতা এক বছরের বেশি টেকেনি। মামার বাড়ির সাথে আমার ছোট চাচার অভিমান ভেঙ্গে যাওয়ার পর স্কুলের কাছাকাছি চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হল আত্মীয়তার বন্ধনকে দৃঢ় করতে নিজেরই রক্ত সম্পর্কীয় আপনজনদের কাছে। ত্রিশালের দরিরামপুরে নজরুলের গড়ে উঠা পাঁচ বছরের আত্মিক সম্পর্কের বিবেচনায় আমার এক বছরের এ মধূর স্মৃতি তুলনামূলকভাবে এক পঞ্চমাংশের চেয়ে অনেক বেশিই ছিল মনে হয়। চলে আসার মুহূর্তটি এক বছর পূর্বেকার বাড়ির বিদায়ের বেদনাঘন মুহূর্তের চেয়ে কোন অংশেই কম ছিল না। হয়ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর আতিয়ার রহমানের মত অপরিশোধ্য দেড়শত টাকার ঋণের বোঝা আমার উপর ছিল না তথাপি শৈশবের ফেলে আসা সে অফুরন্ত স্নেহ ভালবাসা, ভাললাগার দায়বদ্ধতা আদৌ কম ছিল না। বিদায় ক্ষণে অনেকের চোখের কোণের অশ্রুজলে সূর্য কিরণের প্রতিফলন আমি দেখেছি। বছর খানেক সময় ও মনোবৃদ্ধির কারণে আগের মত বাড়ি থেকে চলে আসার সময় বার বার পিছু ফিরে না থাকালেও সজল নয়নে দৃঢ়পায়ে চাচার সাথেই সম্মুখপানে এগিয়ে চলেছিলাম এক অন্যরকম কষ্টকে বহন করে।
হয়ত আজ অনেকেই নেই, অনেকেই বেঁচে আছেন, সময়ের ব্যবধানে অর্ধ শতাব্দী পর বহুদূর চলে আসলেও হৃদয়ের টান এখনো বেশিদূর যেতে দিল কই। তাইত অক্টোপাসের মত নস্টালজিয়া ভর করে আছে যেন সবটুকু সময় ও হৃদয়।