তাহমিনা বেগম গিনি
“দাদু, জানো ঐ দু’জন শিক্ষক বিশজনেরও বেশী ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে।” পূণ্য ২/৩দিন আগে এক সন্ধ্যায় যখন আমাকে এই কথাগুলো বললো তখন আমি শুধু অবাক হয়ে ভাবছিলাম- ও কি তবে ধর্ষণ কি তা বোঝে? লজ্জায় সাহস করে কিছুই জিজ্ঞাসা করতে পারিনি। মনে পড়ে গেল ২০বছর আগের কথা। আমার ছোট ছেলে তখন ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ে। ধর্ষণ শব্দটি কদাচিত খবরের পাতায় আসত। খবরের কাগজ পড়ার সময়ও আমাকে হঠাৎ প্রশ্ন করল “আম্মু ধর্ষণ কি”? তখনও কিছু বলিনি। আসলেই আমরা এগিয়েছি, অনেক দূর এগিয়েছি। এখন আমাদের শিশুদের কিছু শিখিয়ে দিতে হয় না। ওরা নিজেরাই শিখে নেয়। চোঁখের সামনে ভেসে উঠে একাত্তর। তখন যার ঘরে ছেলে ছিল তার যেমন বিপদ ছিল, তেমনি মেয়ে থাকলে আতংকগ্রস্ত হয়ে দিবানিশি পার করতে হতো। মনের তীব্র দহনে, লজ্জায়, মানসিক দায়বদ্ধতা থেকে আজকের এই লেখা। ধর্ষণ, যৌন হয়রানী, অনৈতিক সম্পর্ক, শ্লীলতাহানী, আজকাল বহুল আলোচিত শব্দ। খবরের কাগজের প্রথম পাতায়, টেলিভিশনের প্রতিটি খবরে হত্যা, গুম, খুনের সাথে ধর্ষণে মৃত্যুর খবর বিশেষ করে শিশুর মৃত্যুর খবর আজকাল যেন ডালভাত হয়ে গেছে। অনেকে খবরের কাগজ পড়া, টিভির খবর দেখা ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু এসব কোনো সমাধান নয়। ধর্ষণ এখন বাংলাদেশে মহামারী। প্রতিদিন শুধু নয়, প্রতি মিনিট, ঘন্টায় দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা। ৯ মাসের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধা আক্রান্ত হচ্ছেন। ধর্ষক ১৪/১৫ বছরের কিশোর থেকে শুরু করে ৭০/৭৫ বয়সের বৃদ্ধ। কতগুলো ঘটনা পুরো বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জে ২ শিক্ষক কর্তৃক ২০জনেরও অধিক ছাত্রীকে পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ, মাদ্রাসার শিক্ষক, অধ্যক্ষ কর্তৃক পালাক্রমে ১২/১৩ জন শিশু ধর্ষণ। কোরআন স্পর্শ করে প্রতিজ্ঞা করানো ছাত্রীর সাথে মাকেও ধর্ষণ। কোচিং সেন্টারে ধর্ষণ, স্কুল বাস, ভ্যানে ধর্ষণ, শিক্ষালয়ে ধর্ষণ, শ্রেণিতে ধর্ষণ, প্রধান শিক্ষকের অফিসে ধর্ষণ-এ দেশের কোথাও আমাদের শিশুরা, কন্যারা নিরাপদ নয়। গৃহকোণেও নয়-পাশের বাসায় খেলতে গেলেও হচ্ছে ধর্ষিতা, শুধু তাই নয় অনেকক্ষেত্রে মৃত্যুকেও বরণ করতে হচ্ছে। ধর্ষণের ধরণ, নির্যাতনের ভয়াবহতা দেখে সমাজ বিজ্ঞানীরা আতংকগ্রস্ত। আজকাল চাকুরিজীবী নারী, কিশোরী, যুবতি, মহিলা ঘর থেকে বের হলে ঘরে ফিরে না আসা পর্যন্ত পরিবারের সদস্যরা চিন্তিত থাকেন। আমাদের স্কুল, কলেজ পড়–য়া মেয়েরা অনেক সময় নিজেরাই এই ফাঁদে পড়েন। প্রেমিককে বিশ্বাস করে আজকাল অনেক মেয়ে গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে। মোবাইলের ওপর অতিরিক্ত আস্থা আজ আমাদের ছেলে মেয়েদের বিপদগামী করে তুলেছে। অনেকে পরামর্শ দিয়েছেন মা, বাবাকে সচেতন হতে। আজকাল একটি মায়ের ২/১ জন কন্যা সন্তান থাকলে, হাজার কাজের মাঝেও মাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যয় করতে হয় কন্যার পিছনেই। স্কুল, কোচিং, গান, নাচ, আবৃত্তি, অংকন, প্রাইভেট, বাসায় সর্বক্ষেত্রেই কন্যার প্রতি নজরদারী এখনকার মায়েদের একটি বাড়তি কাজ। তারপরও তো ধর্ষণ, অপহরণ, হত্যা, কমছে না বরং বেড়েই চলছে। ভেবে পাইনা মা’রা আর কিভাবে সচেতন হবেন? ধর্ষণ যারা করেন তারা তো এই সমাজের পুরুষেরই প্রতিনিধি- আমাদেরই ছেলে, ভাই, মামা, চাচা, বাবারা। হঠাৎ করে তাদের এত নৈতিক স্খলন কেন হলো তা কি সমাজ বিজ্ঞানীরা ভেবে দেখছেন? এক থানায় ওসির বক্তব্য “ভেবে পাইনা এক বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে কি পায়”? ভাবিয়ে তুলছে সমাজবুদ্ধাদের এসব বিকৃত মানসিকতায়। আজকাল হাতের মুঠোয় সবকিছু আছে। আমাদের সময় পর্ণ পত্রিকা ফুটপাথে লুকিয়ে বিক্রি হতো। কেউ কিনলেও সবার চক্ষুর আড়ালে রাখা হতো। এখন মুঠোফোনের কল্যাণে যুব সমাজ একসাথে বসে সব দেখছে, বুদ্ধি আটছে এবং তা কার্যকর করছে। সেই সাথে আছে মাদকের অবাধ বিচরণ। দেশের এমন একটি অঞ্চল নেই যেখানো মাদকের অবাধ ব্যবহার নেই। মাদকাসক্তরা তরুণ সমাজের অংশ। বিচারহীনতা এর মূল কারণ। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসুত্রিতা একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ করেও অপরাধী গ্রেফতার হয় না। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হলেও তারা বিচার ও শাস্তি এড়িয়েই চলতে পারে। আমাদের সমাজে এখন মানিবক মূল্যবোধ এবং নৈতিক শিক্ষা চরম অবক্ষয়ের সম্মুখীন। মা, বাবা ব্যস্ত সমাজে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করতে। যে টুকুন সময় পান তাও মোবাইল বা টিভির সিরিয়ালে পার করেন। এক শিশু একবার দুঃখ করে বলেছিল “আমি যদি মোবাইল হতাম মা বাবা আমাকে সবসময় সময় দিতেন”। ভেবে দেখুন পরিবার কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? খুব কম পরিবারেই ধর্মীয় এবং নৈতিক শিক্ষার আবহ আছে। শুধু হিজাব মাথায় দিয়ে কন্যা শিশুকে বাহিরে পাঠালে ধর্মীয় নীতি মানা হয় না। কেউ কিছু মনে করবেন না- আজকাল অনেকের হিজাব দেখে মনে হয়, নতুন ফ্যাশন। পরিবারে ধর্মীয় এবং নৈতিক শিক্ষা ছেলে-মেয়ে উভয়ের জন্য জরুরী। আমাদের শিক্ষালয়গুলোতে এখন বাণিজ্যের বেসাতি চলে। সমস্ত শিক্ষালয়ে নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। শিক্ষক নিয়োগেও শিক্ষকের পূর্ব জীবনের কর্মকান্ডের খোঁজখবর নেওয়া দরকার। কোথাও নিরাপদ নয় আমাদের কন্যারা-তাই। ধর্ষণ শিশুদের চরম মানবাধিকার লংঘন। ধর্ষণের অপারাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার। শিশু ধর্ষণ সহ সব ধর্ষণকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে পবিরার, সমাজ ও রাষ্ট্র-তিন জায়গা থেকেই কাজ করতে হবে। রাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে-অপরাধ বাড়বে না অপরাধী সুরক্ষা পাবে, নাকি শিশুদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরি হবে। তাহলে সর্বশক্তি দিয়ে ধর্ষকদের, মাদক ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে নামতে হবে। স্কুল, মাদ্রাসা, কোচিং কেন্দ্রগুলোকে কঠোর নজরদারীতে রাখতে হবে। শিক্ষক নিয়োগে নৈতিকতাটি একটি আবশ্যকীয় মানদন্ড হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর সংস্কৃতির প্রসারে বিশেষ করে জোর দিতে হবে। বাংলাদেশই বোধ হয় পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে সমাজের এক বিশাল ক্ষমতাশীল অংশ সন্তানদের হাতে মাদক তুলে দিয়ে অট্টালিকা বানায়, কোটি টাকার গাড়ীতে চড়ে। এসব প্রতিরোধ করা কঠিন-তবে কাজটা রাষ্ট্রকেই শুরু করতে হবে। তাহলে সমাজে প্রতিরোধ গড়ে উঠবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিশু ধর্ষণে মৃত্যুদন্ডের আইন করেছেন। সাধুবাদ জানাই আপনাকে। সাক্ষী প্রমাণ সব হাতে থাকা সত্ত্বেও বিচারের দীর্ঘসূত্রিতায় ধর্ষক জামিনে বেড়িয়ে এসে পুনরায় ধর্ষণ করে। আমরা এই আইনের অতিসত্ত্বর দৃষ্টান্তমূলক প্রয়োগ দেখতে চাই। তা না হলে সমাজ যত প্রতিরোধ গড়–ক না কেন, কাক্সিক্ষত ফল আসবে না। আমাদের আত্মায় পঁচন ধরেছে। একদিনে সারবে না। কিন্তু সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে সম্পূর্ণ নিরাময় হওয়া সম্ভব। আসুন আমরা আবার স্বপ্ন দেখি-
আমরা আমাদের দেশকে আমাদের শিশুর বাসযোগ্য করে তুলব, এ আমাদের সবার অঙ্গীকার।