স্টাফ রিপোর্টার ॥ জ্ঞান, বিদ্যা, বুদ্ধি, সুর সাধনা আর দেশ জাতির মঙ্গল কামনায় আজ পূজিত হবেন শিব কন্যা দেবী সরস্বতী। ১৫ই মাঘ, বাংলাদেশ ১৭ই মাঘ সূর্যোদয় ইং ঘন্টা ৬/৫২/৩৪ গতে, সূর্যাস্ত ৫/৪৫/৫৯ সেঃ গতে পঞ্চমী তিথিতে দেবীর পূজো অনুষ্ঠিত হবে। বিদ্যার দেবী হিসাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের কাছে এটি অন্যতম পূজা। দেবী বন্দনায় মুখরিত থাকবে গোটা জেলা। পূজা মন্ডপকে ঘিরে বিরাজ করবে আনন্দের ঘনঘটা। ঢাকের বাদ্য, উলুধ্বনি আর শঙ্খ ধ্বণির সুরে চলবে দেবীর পূজো অর্চনা।
এদিকে দেবী বন্দনায় নানান আয়োজনে গতকাল রাত পর্যন্ত মন্ডপগুলোতে ছিল শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততম প্রস্তুতি। জেলাজুড়ে বিভিন্ন বিদ্যাপীঠ, মন্দির, অফিস পাড়া ও ব্যক্তিগতভাবে প্রায় কয়েক শতাধিক স্থানে দেবীকে বরণে নানান আয়োজন চলছে।
প্রতিমা নির্মাণে কারখানাগুলোতেও ছিল কারিগরদের ব্যস্ততা। দেবীকে শৈল্পিক বর্ধণে শেষ মুহূর্তে রঙ তুলি ও হাতের ছোঁয়ায় প্রতিমা সাজাতে গভীর রাত পর্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করছেন শিল্পীরা।
জানা যায়, হিন্দু ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী চিরউজ্জীবিত স্বরসতী দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হবে। ফুল, বেলপাতা, ধূপ, প্রদীপ প্রজ্বলন, ভোগ, আরতি, যজ্ঞ, পুষ্পাঞ্জলী প্রদানের মাধ্যমে পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। সরস্বতী পূজা উপলক্ষে বাণী অর্চনায় বিভিন্ন সংঘের উদ্যোগে থাকছে ধর্মীয় আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রসাদ বিতরণী।
প্রতিমা নির্মাণ কারখানাগুলো ঘুরে দেখা যায়, দেবী সরস্বতীকে বিভিন্ন আকার আর ভিন্ন-ভিন্ন ভঙ্গিমায় সাঁজানো হয়েছে। বাঁস, খড়-কুটো, পাট, কাঁদা মাটির মিশ্রনে দেবীর অবক্ষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কাঁঠামোগুলোতে। এসব প্রতিমা মূর্তিগুলো ছাঁচের ছাঁপের আকৃতিতে এবং বাঁসের কাঠামোর উপরে নির্মিত হয়ে থাকে। আঁকারে কোন-কোন প্রতিমা মূর্তি ১ ফুট বা তাঁরও নিচ থেকে শুরু হয়ে ৮/১০ ফুট উচ্চতায় হয়ে রয়েছে। নির্মিত প্রতিমাগুলো আঁকার আর ডিজাইন অনুসারে কারিগরদের নির্মাণ পরিশ্রম অনুসারে পারিশ্রমিক হাঁকাচ্ছে। তবে এসব প্রতিমা নির্মাণের যে খরচ এবং শ্রম ব্যয় করতে হয় সে অনুযায়ী শিল্পী কারিগরদের পারিশ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না বলে দাবী প্রতিমা নির্মাণ কারিগরদের।
প্রতিমা কারখানার নির্মাণ শিল্পীরা জানায়, এসব প্রতিমা তৈরীতে দীর্ঘ এক মাসেরও বেশি সময় ব্যয় করতে হয়েছে। আঁকারে ছোট প্রতিমাগুলো ১ হাজার থেকে শুরু করে ৩/৪ হাজার টাকা মূল্যের হয়ে থাকে। আর বড় আঁকারের ৭/১০ ফুট উচ্চতায় প্রতিমাগুলো ১২/১৫ হাজার টাকা মূল্যের হয়ে থাকে। নির্মিত এসব প্রতিমাগুলো বিভিন্ন ডিজাইনের হয়ে থাকে। বিদ্যার দেবী হিসেবে সরস্বতী পূজো মূলত ছাত্র/ছাত্রীরাই বিভিন্নভাবে চাঁদা তুলে পূজোর আয়োজন করে থাকে। দেবীর প্রতিমার মূর্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কিভাবে বা কোন ডিজাইনে সরস্বতী দেবীকে সুন্দর করে ফুঁটিয়ে তোলা যায় সে ডিজাইনও অনেক ছাত্র/ছাত্রী আমাদের দিয়ে যায়, আমরা চেষ্টা করি সে ভাবেই দেবী প্রতিমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে। তবে দু:খের বিষয় আমাদের শৈল্পিকতার পরিশ্রম অনুযায়ী পারিশ্রমীক পাই না। তাঁর পরেও বাপ-দাদাদের শেখানো পেশাতে কোনভাবে টিকে আছি। হয়তো এমনও দেখা যায় কারখানায় যে মূর্তিগুলো নির্মাণ করা হয়েছে তার কিছু অংশ বিক্রি হলো আবার বেশ কিছু মূর্তি অবিক্রিত অবস্থায়ও থাকে। এতে আমাদের যেমন শ্রমের ক্ষতি তেমনি মূর্তি নির্মাণে ব্যয় করা অর্থের ক্ষতি হচ্ছে। কারণ যেখানে মূর্তি তৈরী করতে হয় প্রয়োজনীয় জিনিষ ক্রয়সহ সহকারী শ্রমিকের বেতন, বিভিন্ন রং, বার্নিশ, বিদ্যুৎ বিল, ঘর ভাড়াসহ আনুষাঙ্গিক খরচ মেটাতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের তৈরী মূর্তি বিক্রী হলেও খরচগুলো মেটাতে হয়, মূর্তি বিক্রি না হলেও খরচ মেটাতে হবে। হয়তো সিজোনাল ভাবে সময়টাতে মূর্তিগুলো নির্মাণ করে বিক্রি করছি না হলে সারা বছর কষ্টের মাঝেই দিনানিপাত করতে হয় আমাদের। এমনও দেখা যায়, আধুনিক মেশিন এবং ঢাকা নারায়ণগঞ্জে কারখানাগুলো থেকেও বিভিন্ন ডিজাইনের মূর্তি ক্রয় করে আনা হচ্ছে জেলা শহরের বিভিন্ন মন্ডপগুলোতে এতে আমার মতো স্থানীয় মৃতশিল্পী কারিগরদের জন্য প্রতিযোগিতা মূলত মার্কেটে টিকে থাকা দায় হয়ে যাচ্ছে। তারপরেও হাজারো কষ্টের মাঝে বছরের এ সময়টাতে নিজেদের শৈল্পিকতায় প্রতিমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে আমরাও এক ধরণের আনন্দ পেয়ে থাকি। তবে আমাদের জন্যে সরকারি পৃষ্ট পোষকতার অতীব দরকার, না হলে এ পেশার সাথে কেউ জড়িত হতে চাচ্ছে না। হয়তো কোন একসময়ে আমাদের মতোন শিল্পীরা হারিয়ে যাবে।
সরস্বতী শুধু বিদ্যার দেবী হিসাবেই নন সুরের দেবীও বলা হয় তাকে। সরস্বতীর বাহন সাদা বর্ণের রাজহংস। তিনি পদ্ম ফুলে উপবিষ্ট থাকেন। তার হাতে থাকে সুরের প্রতীক বীনা। ডান হাতে আশির্বাদ প্রদত্ত হয়। শারদীয় ও বাসন্তি পূজাতেও দেবী দূর্গার কন্যা এবং মাতৃরুপে সরস্বতী দেবীর পূজা করা হয়ে থাকে। সরস্বতী পূজাকে কেন্দ্র করে জেলা শহরের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ প্রশাসন জোরদার করা হয়েছে। বিভিন্ন বানী অর্চনায় সংঘের উদ্যোগে আয়োজিত পূজাকে সাফল্য মন্ডিত করতে শহরগুলোতেও দলবন্ধ হয়ে প্রণামী সংগ্রহ করতে দেখা মিলে বিভিন্ন ছাত্রছাত্রীদের।
হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র স্বরূপ দত্ত পল্লব জানায়, সরস্বতী পূজা সার্বজনীন। মায়ের আশির্বাদ পেতে সবার মঙ্গল কামনায় আমি উপোস করব। প্রতিমা তৈরীতে আধুনিক প্রযুক্তিকে ব্যবহার সৌন্দর্য বর্ধন আর শৈল্পিকতায় নয় দেবী রুপের মা সবার কাছেই সমান এবং সর্বত্র বিরাজিত রয়েছে। পূজোর দিনটিতে আমার সহপাঠিরা মিলে বিভিন্ন মন্ডপে ঘুরতে যাব এবং আনন্দ উপভোগ করব। দিনটিকে ঘিরে সৌহার্দ্য সম্প্রীতিময় একটি মিলন মেলায় পরিণত হবে।
দেবী বন্দনায় মন্ডপজুড়ে ছাত্রছাত্রীদের নানা আয়োজন
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com