দলিত সংখ্যালঘু মেয়ে বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে নিগৃহীত হওয়ার পর সে অনেক ক্ষেত্রে অত্যাচার সহ্য করে এই ভেবে যে তার যাওয়ার আর কোন জায়গা নেই। অপরদিকে আয় উপার্জনে তার নিজস্ব কোন সক্ষমতা না থাকায় নিষ্ঠুর অত্যাচার তাকে সহ্য করতে হয়
মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ বাংলাদেশে মুসলিম নারীদের মানবাধিকার বা সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। যা মুসলিম পারিবারিক আইন নামে পরিচিত। সেই আইন মুসলিম নারীদের মানবাধিকার পাওয়ার পথ সুগম করেছে। কিন্তু সংখ্যালঘু বা হিন্দু নারীদের মানবাধিকার বা সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় সুনির্দিষ্ট কোন আইন নেই। ফলে হিন্দু মেয়েরা নিজের অধিকার থেকে বঞ্চিত হলেও প্রতিকার নিতে পারে না। তাই সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু নারীদের মানবাধিকার বা সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় ধর্মীয় বিধি নিষেধের আলোকে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন হিন্দু নেতৃবৃন্দ।
হবিগঞ্জ কালীবাড়ি কমিটি ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ হবিগঞ্জ জেলা শাখার সদস্য এবং হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট অহীন্দ্র দত্ত চৌধুরী বলেন, সংখ্যালঘু নারীদের বিশেষত হিন্দু নারীদের পিতার সম্পত্তিতে অধিকার না থাকায় তাদের বিবাহ পরবর্তী জীবনযাপন বেশ কষ্টকর হয়। এ বিষয়ে ভারতে আইন প্রণীত হলেও আমাদের দেশে এখনো এ ধরণের আইন প্রণীত হয়নি। ফলে মেয়েরা সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের বাইরে থেকে যায়। দলিত সংখ্যালঘুদের শিক্ষার সুযোগ বেশি না থাকায় তারা তাদের নিজেদের কর্ম দ্বারা সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়া খুবই দুরূহ হয়ে উঠে। তাছাড়া মানবাধিকারের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে থাকার মূল কারণ শিক্ষার অভাব। প্রায়শই দেখা যায় প্রাইমারী শিক্ষার পর পড়াশুনাতে তাদের তেমন কোন আগ্রহ থাকে না। তার মুখ্য কারণ নিরাপত্তাহীনতা। একটি মেয়ে ১৩/১৪ বছর বয়সেই পিতা-মাতার কাছে বোঝা হয়ে যায়। যে কারণে দ্রুত তাদের বিয়ে দেয়ার প্রবণতা অভিভাবকদের মাঝে লক্ষনীয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের মেয়েদের শিক্ষার হার অর্থাৎ গুণগত শিক্ষার হার না বাড়ালে এবং তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার মতো অবস্থা তৈরী করতে না পারলে তাদের পক্ষে মানবাধিকার এবং সমঅধিকার উভয় বিষয়ই অধরা থেকে যাবে। প্রায়শই দেখা যায় একটি দলিত সংখ্যালঘু মেয়ে বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে নিগৃহীত হওয়ার পর সে অনেক ক্ষেত্রে অত্যাচার সহ্য করে এই ভেবে যে তার যাওয়ার আর কোন জায়গা নেই। অপরদিকে আয় উপার্জনে তার নিজস্ব কোন সক্ষমতা না থাকায় নিষ্ঠুর অত্যাচার তাকে সহ্য করতে হয়। ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক আইন নামে একটি আইন আছে। সেই আইনটি মুসলিম নারীদের অনেক ক্ষেত্রে বিচার পাওয়ার পথ সুগম করেছে। হিন্দুদের জন্যও এরূপ একটি আইন ধর্মীয় বিধি নিষেধের আলোকে করা উচিত। যাতে হিন্দু মেয়েরা স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের বিরুদ্ধে প্রতিকার নিতে পারে। অত্যাচারিত হলে বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য স্বল্প সময়ে বিষয়টি সমাধানের জন্য আইনের আশ্রয় নিতে পারে। তার নিজের এবং সন্তানদের ভরণ পোষণের জন্য আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। বিবাহকালীন সময়ে পিতার দেয়া স্বর্ণালঙ্কার ও অন্যান্য জিনিসপত্র উদ্ধার করতে পারে। এই ধরণের আইনের খুবই প্রয়োজন। তাছাড়া মেয়েদের পিতার সম্পত্তিতে অধিকার পাওয়া বিশেষত স্থাবর সম্পত্তিতে অধিকার পাওয়া বাধ্যতামূলক করা উচিত। হয়তো এ অভিমতের সাথে সম্প্রদায়ের অনেকেই দ্বিমত পোষণ করবেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে মেয়েদের ভবিষ্যত নিরাপত্তার জন্য এই বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা উচিত। তবে যদি কেউ ধর্মান্তরিত হয়ে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্মে চলে যায় তাহলে সেক্ষেত্রে পিতার সম্পত্তিতে মেয়ের অধিকার গ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া মেয়েদেরকে যদি কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা যায় তাহলে বহুলাংশে সংখ্যালঘু নারীদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। যেখানে মেয়েরা উপার্জনক্ষম নহে সেখানে স্বামীরা তাদের স্ত্রীকে অনেকটা দাসত্বের শৃঙ্খলে রাখে। তাই শিক্ষা এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতার পাশাপাশি যৌথ পরিবারে থাকার মনমানসিকতা এগুলো বিশেষ বিবেচনায় রাখলে সমঅধিকার হয়তো প্রতিষ্ঠিত হবে না, তবে দূরত্ব অনেকাংশে গুছবে।
এ প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট নিলাদ্রী শেখর পুরকায়স্থ টিটু বলেন, আগেকার সময়ে নারীদের শিক্ষার হার অনেক কম ছিল। আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীদের ক্ষেত্রে সে হার ছিল অতি নগন্য। কিন্তু বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর সে ধারা অনেক পাল্টে গেছে। এখন দেশে অশিক্ষিত লোকের সংখ্যা অনেক কমেছে। সে সংখ্যাগুরুই হোক আর সংখ্যালঘুই হোক সকলেই শিক্ষার সুফল ভোগ করছেন। পাচ্ছেন সরকারের সকল সুযোগ সুবিধা। বর্তমান সরকারের আমলে কেউ বেশি আর কেউ কম সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন একথা বলার অবকাশ নেই। তাই স্বভাবতই বলা যায় সংখ্যালঘু মেয়েদের মাঝে যেহেতু শিক্ষার হার বাড়ছে তেমনি তারা তাদের অধিকার সম্পর্কেও সচেতন হচ্ছেন। ফলে এখন আর ঢালাওভাবে বলা যাবে না সংখ্যালঘু নারীরা সমঅধিকার বঞ্চিত। তবে এর ব্যতিক্রমও যে ঘটছে না একথাও বলা যাবে না। কিছু কিছু ঘটছে যা অনেকটা অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে। বিষয়টি প্রকাশ্যে না আসায় নির্যাতিত নারী তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে ধর্মীয় বিধি নিষেধের আলোকে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ণ করা গেলে তাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আর কোন বাধা থাকবে না।
বাংলাদেশের আইন ও সংখ্যালঘু নারীর মানবাধিকার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক শংখ শুভ্র রায় বলেন, সংখ্যালঘু নারীদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবি। তবে খেয়াল রাখতে হবে তা যেন হয় ধর্মীয় বিধি নিষেধের আলোকে। ধর্মকে পাশ কাটিয়ে আইন প্রণয়ন করা হলে তা হিতে বিপরীত হবে। তিনি আরও বলেন, দলিত সংখ্যালঘুদের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে আমরা একটি আইন সহায়তা সেল গঠন করেছি। যা দরিদ্র সংখ্যালঘুদের বিনা খরচে আইন সহায়তা দিয়ে থাকে। তাছাড়া এর কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য একটি কমিটিও রয়েছে। কমিটির সদস্যরা এর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। আমরা আশাবাদী এর মাধ্যমে অবহেলিত, দরিদ্র ও নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে।