আজ হতে ১৮ বছর আগে কোন একদিন আমাদের মসজিদ (শায়েস্তানগর জামে মসজিদ) এ মোয়াজ্জিন হিসেবে আমাদের মাঝে আসেন নুর মোহাম্মদ সাহেব। দেখতে বেশ শান্ত প্রকৃতির এক টগবগে যুবক। চেহারা মায়াবী, নিরীহভাব। কেনজানি তাকে দেখতে বেশ ভাল লাগত। তার অমায়িক ব্যবহার আস্তে আস্তে মসজিদের মুসল্লীদের আকৃষ্ট করতে লাগল। কখন যে তিনি মসজিদের মুসল্লীদের গন্ডি পেরিয়ে আশপাশের এলাকা এমনকি পুরো শহর নিজের কব্জায় নিয়ে নিলেন তা কেউ ঠেরই পায়নি। এমনকি তার সাথের ইমাম, মোয়াজ্জিনও বুঝতে পারেনি। যখন আমরা বুঝতে পারলাম তখন সূর্যটা পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। তার একটু পরেই ডুবে গেল। হঠাৎ ফেসবুকে তার মৃত্যুর খবরটা দেখি। প্রথমে এলাকার কিছু ফেসবুক ব্যবহারকারী বন্ধু তার এ খবরটা প্রচার করে। তার পর আরও বহু জনে তা প্রচার করতে থাকে। সিলেটের একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন। রবিবার জোহরের নামাজের পর তার জানাজা নামাজের সময় দেয়া হয়। কর্তৃপক্ষসহ তার কাছের লোকজন মনে করেছিলেন যেহেতু শায়েস্তানগর জামে মসজিদটি বেশ বড় এবং বহু বড় বড় সম্পদশালী, টাকাওয়ালা বিভিন্ন পর্যায়ের লোক মারা গেছেন। তাদের জানাজা মসজিদে হয়েছে। কখনো কখনো একতলা, দু’তলা পর্যন্ত মানুষ হয়েছে। তার জানাজা এখানে পড়ালে তেমন অসুবিধা হবে না। কিন্তু সময় যত ঘনিয়ে এল তখন তা আমার জীবনের জন্য স্মরণীয় হয়ে উঠল। আমি দেখলাম মসজিদের প্রথম ফ্লোরটি কানায় কানায় ভরে গেল। তার পর মনে করলাম মনে হয় মানুষ আসা শেষ। কিন্তু দেখি এক ব্যতিক্রম খেলা মওলার। দ্বিতীয় ফ্লোরটিও কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল। তারপর সবার নজর তখন মসজিদে আসা মানুষগুলোর দিকে। একসময় তা মসজিদের ছাদে গিয়ে ঠেকল। হায়রে মানুষ! আমি দেখি আর চিন্তা করি কখন যে চোখের কোন গলিয়ে অশ্রু ঝড়তে লাগল তা ঠেরই পেলাম না। মানুষ বলাবলি করতে লাগল এতবড় জানাজাতো এ মসজিদে আর কখনো পড়ানো হয়নি। আর আমার মাথায় তখন ঘুরপাক খাচ্ছিল কি ছিল লোকটির মধ্যে। যার কারণে তার জানাজায় এত মানুষের ঢল। কত নেতা, কত মুরুব্বী, কত বংশওয়ালা, পয়সাওয়ালা লোক দেখলাম, মারা যাওয়ার পর এ মসজিদে জানাজা হয়েছে। কিন্তু এত লোক হয়নি। তিনিতো কোন নেতা বা পদ পদবিধারী লোক নন। তিনি ছিলেন একজন সাদা মনের মিষ্টভাষী আল্লাহভক্ত মানুষ। যখন জানাজা নামাজ শেষ হল তখন দেখলাম কত মানুষ কত মাওলানা তার জন্য চোখের পানি ফেলছেন। তখন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। দুটি হাত তুলে আল্লাহর দরবারে বলতে লাগলাম হে আমার মালিক আমার কি এমন জানাজা নসিব হবে। লাশ নিয়ে যাওয়া হল মসজিদের পাশে যেখানটায় তিনি থাকতেন তার পাশে শায়েস্তানগর কবরস্থানে। এটি আরও স্মরণীয় আমার জীবনে। এটাই প্রথম দেখা কবর পাড়ে দাফনে এত মানুষের ভিড়। কি গুণ ছিল তার মধ্যে যার কারণে তার জন্য মানুষের হৃদয়ে এত কান্না। নিশ্চয় তার মধ্যে এমন কিছু ছিল যা অন্যদের মধ্যে নেই। আমার দুটি হাত তুলে আল্লাহকে বলতে লাগলাম ‘হে আমার মালিক এমন যোগ্যতা কি আমার হবে?’ তারপর ভারাক্রান্ত মনে বাসার দিকে রওয়ানা হলাম আর ভাবতে থাকলাম এত সুন্দর একটি মানুষকে কাছে পেয়েও চিনতে পারলাম না। কতইনা দুর্ভাগ্য আমার। হাতের কাছে স্বর্ণ রেখে দূরের অদেখা জিনিসকে হিরা মনে করে তার সাথে মিশতে, তাদের সংস্পর্শে থাকতে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করি। কতইনা বদনসীব আমার। পরিশেষে বলব আমাদেরকে নূর মোহাম্মদের জানাজা ও দাফন পর্যন্ত দেখা দৃশ্যপট থেকে যেন শিক্ষা নেই। আমরা মারা যাওয়ার পর যেন সকলে বিনা স্বার্থে এসে জানাজা নামাজে অংশ নেন। কবরে দাফন পর্যন্ত সাথে থাকেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেদায়েত দান করুন। আর নূর মোহাম্মদকে যেন জান্নাতবাসী করেন।
মোঃ নাছির উদ্দিন
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান
ব্লু বার্ড প্রি-ক্যাডেট স্কুল, হবিগঞ্জ।
পাঠকের চিঠি...
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com