ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
আমি যখন প্রকৃতিকে প্রথম দেখতে শিখেছি, একটু একটু বুঝতে শিখেছি, নিজেরই অজান্তে ভালবাসতে শিখেছি তখন আমার ভাললাগার এদেশটার নাম ‘বাংলাদেশ’ ছিল না। ১৯৪৭ এর পাক-ভারত বিভক্তির ফলশ্রুতিতে তা ছিল পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন জনবহুল অথচ ছোট্ট অংশ পূর্ব পাকিস্তান। আরও একটু যখন বুঝতে শিখলাম তখন আন্দাজ করতে পেরেছিলাম জনসংখ্যায় আমরা পশ্চিমাদের প্রায় দ্বিগুণ হলেও ক্ষমতায় তাদের তুলনায় সিকিভাগও আমাদের আধিপত্য নেই।
প্রাথমিক শিক্ষা জীবনেই প্রতিটা বছর একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের ভিতর দিয়ে ভাষা আন্দোলনে শহীদ রফিক, জব্বার, বরকতের রক্তমাখা লাশ যখন চোখের সামনে ভেসে উঠত কেন জানি বুকটা কচকচ করে উঠত। তখন থেকেই আমার মায়ের ভাষা, আমার ভাষা, আমার সাহিত্যের সমৃদ্ধশালী ভাষা, আমার হাসি-কান্না, আনন্দ, আকুতি ও আবেগের ভাষা ‘বাংলা ভাষা’র প্রতি এক ক্রমশ বর্দ্ধমান অনিন্দময় নির্ভেজাল মমত্ববোধ, ভালবাসা তৈরি হতে থাকলো। প্রথম শ্রেণীর ‘ছড়া ও পড়া’ আমার হাতেখড়ির প্রথম বাংলা সাহিত্য যে ভাললাগা দিয়ে জীবন শুরু হয়েছিল আজ তা কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎ চট্টোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাস, বিভূতি ভূষণ, ফররুখ আহমদ, আল মাহমুদ, আবদুল্লাহ আবু সাঈদ, হুমায়ূন আহমেদের মত কবি ও সাহিত্যিকদের ছোঁয়ায় আমার ভাষাপ্রীতি ও জীবনবোধে যে পরিপক্কতা লাভ করেছে তার জন্য ঋণী আমি এদেশটাতে জন্মেছি বলেই।
আমার ছোট মেয়েটা ক্লাস থ্রি থেকেই জেদ ধরেছিল ভবিষ্যতে সে ডাক্তার হবে। তার মেধা, নিরলস শ্রম, ঐকান্তিকতায় আজ সে বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠতম বিদ্যাপীঠ ঢাকা মেডিকেলে অধ্যয়নরত। প্রতিদিন অবিরাম ছয় সাত ঘণ্টা পড়াশুনার ফাঁকে একদিন সে তাঁর মাকে বলতে শুনলাম, ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানের এ বিষয়গুলো পড়ার সুযোগ না পেলে আমি আর কি পড়তে পারতাম? আর কোন বিষয় আছে বলেতো আমার মনেই হয় না।’ তাঁর এ চিন্তা চেতনার সাথে একই সুরে আমারও কেন জানি মনে হচ্ছে এদেশটা ছাড়া জন্ম নেয়ার মত পৃথিবীতে আর কোন দেশ আছে কি? এত সুর, এত গান, এত আবেগ, এত বিরহ, আনন্দোচ্ছ্বাস অন্য কোন মাতৃভাষায় আছে কি? এত রূপ, সৌন্দর্য্য, বৈচিত্র্যময় লীলাপ্রকৃতি পৃথিবীর অন্য কোনখানে আছে বলেতো আমার মনে হয় না। সুতরাং এদেশ ছাড়া, এ মাতৃভাষা ছাড়া আর কোথাও আমার জন্মটাকে আমি মেনে নিতে পারতাম না। মনে হচ্ছে এ যেন ছিল জন্মপূর্ব আমার হৃদয়কোণে লালিত এক স্বপ্ন, এক ভালবাসা, এক আকুতি। আমি বলব এদেশে জন্মই আমার আজন্ম ভালবাসা, আজন্ম এক পূণ্য।
পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, কুশিয়ারা, তিতাস, করতোয়া, আত্রাই, ধানসিঁড়ি এমনিতর শতশত নদনদী বিধৌত এমন সবুজ সুন্দর দেশ পৃথিবীর আর কোথাও নেইতো। হাইল, হাকালুকি, টাঙ্গুয়া, শনি, চলনবিল এসব নামের বড় বড় হাওর বা বিল কয়টা দেশেইবা আছে। তাজিংডং, কিওক্রাডাং, সাজেক, নীলগিরি, নীলাচলতো আর কোন দেশে নেই। এতবড় এবং সুন্দরতম একটা সমুদ্র সৈকত বলুনতো আর কোথায় পাওয়া যাবে? সপ্তাশ্চর্যের দাবিদার সুন্দরী, গজারি, গোলপাতা এবং মায়া ও চিত্রা হরিণ সমৃদ্ধ রয়েল বেঙ্গল টাইগার কর্তৃক প্রহরারত এমন বৃহৎ একটা ম্যানগ্রোভ বা সুন্দরবন কোথাও দেখেছেন কি?
আমার এ জন্মভূমির ভৌগোলিক অবস্থানটা একবার বিবেচনা করুন। দু’তিনটা নদীবন্দর সমৃদ্ধ এমনতর সাগর সংলগ্ন দেশের সংখ্যা সারা পৃথিবীতে অপ্রতুল।
একদিকে যেমন মিঠাপানির মাছে ভরপুর নদী-নালা, হাওর বাওর, খাল-বিল, পুকুর, অন্যদিকে আছে পাহাড়-পর্বতঘেরা ছায়া সুনিবিড় অপরূপ শ্যামলিমা। আছে অসংখ্য উন্নতমানের চা-বাগান। আছে উন্নতমানের সেগুন সহ আকাশি, গজারি, জারুল, কাঁঠাল, কড়ই সহ অনেক মূল্যবান কাষ্টসম্পদ। আছে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, আনারস, লটকন সহ বিভিন্ন ফল ফলাদি। কি নেই ছোট আমার এ দেশটাতে। আছে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃস্টধর্ম সমেত চাকমা, মারমা, মং, গারো, ত্রিপুরা, মনিপুরী, সাঁওতাল সহ বহু জাতির এক অসাম্প্রদায়িক এক মহাসমাবেশ বা সহাবস্থান।
এ যে শাহজালাল, শাহপরানের দেশ, এদেশ শেখ ফরিদের দেশ, বায়েজিদ বোস্তামীর দেশ, হাজী শরিয়ত উল্লাহর দেশ।
এ যে হাছন, লালন, শাহ আবদুল করিম আর রাধা রমণের দেশ। এতো আব্বাছ উদ্দিন, আবদুল আলীম, নীনা হামিদ, রথীন্দ্র নাথ, ফেরদৌসী রহমান, আর আরতি ধরদের দেশ। এ যে রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, কনক চাঁপা আর বশির আহমদদের দেশ।
তাই আবারো বলি..
“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।”