স্মৃতির দর্পনে

তাহমিনা বেগম গিনি
বহুদিন পর সেদিন ঢাকা গেলাম। ঢাকা গেলেই খুঁজে ফিরি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু বান্ধবীদের। বন্ধু বান্ধবদের সংখ্যা কোনোদিনই আমার দীর্ঘ নয় তবে অনেকের মাঝে কয়েকজনের নাম এই পঞ্চাশোর্ধ বয়সে এসে প্রায়ই মনে পড়ে। একেবারে শিশুবয়সে বরিশালের জাহাঙ্গীর, নীলুফার, শাকিলা- পরীক্ষার স্থান নির্বাচনে সাংঘাতিক রকমের প্রতিযোগিতা ছিল আমাদের মাঝে। জাহাঙ্গীর কলেজ জীবনে আমাকে খুব সুন্দর একটি চিঠি লিখেছিল। বয়ঃসন্ধিকালে বুলু, ফাহিমা, এবি, কনা, এরা সবাই ছিল রাজশাহীর, যৌবনে খুরশীদা, কনিকা, ময়না, জুরুল ইসলাম, জিন্না, মান্নান, বেনু, রোকন- কেউ গাইবান্ধার, কেউ বগুড়ার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই নিমাইখোষের মেমসাহেব সেজে নাজিয়া, ছেলেরা যার নাম দিয়েছে সেক্সবোম সেই শামীমা। বাংলার অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম স্যার কারণে অকারণে যাকে রুমে ডেকে পাঠাতেন। মিষ্টি মেয়ে শিউলী মনে মনে সহপাঠি একটি ছেলেকে ভালবাসত। মনে পড়ে সিলেটের শ্যামের কথা, দেখতে যেমন সুন্দর ছিল, পড়াশোনাতে ভাল ছিল। আজও কোনো কোনে অবসরে মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই ছেলেটির কথা যে আমাকে বলেছিল তুই এখানে আসার আগেই বুকড হয়ে আসলি কেন? মনে পড়ে সলিমুল্লাহ হলের সেই ছেলেটিকে যে প্রায় শামসুন্নাহার হলে ১১৩ নং রুমের ঠিকানায় ডাকে আমাকে চিঠি পাঠাতো। চোখের সামনে ভেসে ওঠে রাজবাড়ির দেবাহুতি চক্রবর্তীর সুন্দর মুখটি। সে নি¤œবর্ণের সুব্রতকে ভালবেসে তখনই বিয়ে করেছিল। আমি সেদিন সুব্রতকে দেখি সেদিন একটুও ভাল লাগেনি। দেবাহুতির পাশে একটুকুও মানায়নি মনে হয়েছিল। এম,এ মৌখিক পরীক্ষার দিন ডক্টর নীলিমা ইব্রাহীম দেবাহুতিকে প্রশ্ন করেছিলেন, তুমি বিবাহিতা হিন্দু মেয়ে হয়েও সিঁথিতে সিঁদুর শাখা পরনি কেন? সাহসের সাথে সেই সত্তর দশকে উত্তর দিয়েছিল, সবই তো আমরা পরি স্বামীদের কল্যাণের জন্য কিন্তু স্বামীরা কি পরেন? মাসখানেক আগে রাজবাড়ির একজনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম দেবাহুতিকে চেনে কি না? জানালো সুব্রত’র সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়ে দেবাহুতি এখন রাজবাড়ির নামকরা উকিল। মনে পড়ে ১১৩ নং রুমের আমার দুইজন রুমমেটের কথা। যশোহরের রুনা, নারায়ণগঞ্জের নাজু। জুনিয়র মেয়ে দুটি অনেক ভাল ছিল। জানি না এখন ওরা কোথায় আছে। খুব জানতে ইচ্ছে করে। মনে পড়ে হলের আমাদের সহপাঠি রানু, প্রতিদিনকার গাড়ীতে চড়ে চাইনীজ থেকে যেতো। বুড়ী প্রায় সন্ধ্যায় গেট বন্ধ হয়ে যাবার পর রাজা ভাইকে টাকা দিয়ে হলে ঢুকতো। নীল খামে নীল কাগজে চিঠি আসতো তার। আমার চিঠিও প্রায় প্রতিদিনই আসতো। খুউব ভাল লাগতো। কোনোদিন পুরো সাদা পৃষ্ঠায় একটি কথা লেখা থাকতো ‘ভালবাসি’। প্রায় প্রতিদিনই এই চিঠি আমাকে কেন্দ্র করে শামসুন্নাহার হলে খুবই আলোচিত ছিলাম। তবে সবাই জানতো কে আমাকে এত চিঠি লেখে। আরও অনেকের নাম স্মৃতির আড়ালে চলে গিয়েছে। চেহারাগুলো মনে আছে কিন্তু নামগুলো মনে করতে পারি না-বয়স হয়েছে তাই। কলকাতা থেকে চিঠি লিখতো মানস নামের একটি ছেলে। নকশালপন্থী ছিল যুবকটি। সারা পাতা ভরে শুধু থাকতো সমাজ সংস্কারের কথা। হঠাৎ করে কেন যেন বন্ধ করে দিল চিঠি লেখা। সহপাঠি শেফালি, সাবির, রানু আপা যাদের সাথে আজো যোগাযোগ আছে। শেফা’র মগবাজারের বাসায় দীর্ঘদিন ভাড়া হিসেবে থেকে আমার দু ছেলে তাদের লেখাপড়া শেষ করেছে। তাই আমি যখনই ঢাকা যেতাম শেফালীর সাথে জমতো খুব। সব পুরানো বান্ধবীদের খুঁজে বের করতাম, টিএসসি যেতাম, হলে যেতাম, পুরানো জায়গাগুলো ঘুরে বেড়াতাম। শেফালীর সাথে যখন গল্প হতো তখন ও প্রায়ই আমাকে বলত আমি একটি বৃদ্ধানিবাস বানাবো। শুধু অসহায় মা-দের জন্য। তুই হবিগঞ্জ থেকে মাঝে মাঝে আসবি। অসহায় বৃদ্ধাদের সাথে গল্প করে ভালো সময় কাটবে। তুই তো লিখিস। লেখার অনেক বিষয় পাবি। আমি তখন মনে করেছিলাম এগুলি সবই বুঝি ওর কথার ছলে কথা। মাঝখানে বেশ কটি বছর পার হয়ে গিয়েছে। আমার দু ছেলের বিয়ে করিয়েছি। পূণ্য আমার জীবনে এসেছে। শেফালীরও বড় ছেলে বিয়ে করিয়েছে। দাওয়াতপত্র পাঠিয়েছিল যেতে পারিনি। ঢাকা থেকে ছেলেরা চলে এসেছে সেই কবে। ঢাকা আমার পছন্দের নগরী নয়। সত্তর দশকের ঢাকাকে এখনও আমি খুঁজে ফিরি। এখন তো ঢাকা যাওয়া শারীরিক চেকআপের জন্য। বছরখানেক আগে এমনি এক কারণে ঢাকা গিয়ে মনে হলো শেফালীর সাথে একটু দেখা করেই যাই। ওর বাসায় যেয়ে অবাক হলাম। আমার ছেলেরা যে চারতলা বাসাতে ছিল সেখানে একটি বৃদ্ধানিবাসের সাইনবোর্ড দেওয়া। পাশেই ও বড় আরেকটি বাড়ি বানিয়েছে বসবাসের জন্য। আমি নতুন বাড়ির দুই তলায় কলিংবেল টিপতেই একটি কিশোর গৃহপরিচারক দরজা খুললো। শেফালী আছে নাকি প্রশ্ন করতেই জানতে পারলাম শেফালী বৃদ্ধা নিবাসে থাকে। অবাক হয়ে ধীরপায়ে বৃদ্ধা নিবাসে এলাম। তিনতলায় শেফালীকে পেলাম। মনে হলো বয়স যেন অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। আমাকে অনেকদিন পর পেয়ে জড়িয়ে ধরলো। আমি ওকে শুধু জিজ্ঞাসা করলাম তুই এখানে থাকিস কেন? শেফালীর দুটি চোখ পানিতে ভরে উঠলো। কোনো কথা না বলে ভেজা চোখে নীচে নেমে এলাম।