আমি জীবনে কখনও বিদেশের নাম নেব না আমাকে এই জাহান্নাম থেকে রক্ষা করুন

আবুল কালাম আজাদ, চুনারুঘাট থেকে ॥ ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিতে না পারায় লিবিয়ায় অন্ধকার টর্চারসেলে বন্দি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার যুবক সামাজুল ইসলাম। উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখে জীবনের সহায় সম্বল একটি সিএনজি বিক্রি ও ধারকর্জ করে বিদেশ গিয়ে এখন অন্ধকার প্রকোষ্টে বন্দি সামাজুল। প্রায় ৪ মাস ধরে অন্ধকার প্রকোষ্টে বন্দি রেখে ২০/২২ দিন পূর্বে দেশে তার ভাইয়ের কাছে ১০ লাখ মুক্তিপন দাবি করেছে দালালচক্র। অন্যথায় তাকে ফেরত দেওয়া হবে না বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় কোন উপায়ন্তর না দেখে পিতৃহীন সামাজুলের চাচা বাদী হয়ে হবিগঞ্জ মানব পাচার ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করেছেন।
এদিকে তার স্ত্রী ও দুই সন্তান বাড়িতে চরম দুর্বিসহ দিনযাপন করছেন। তার স্ত্রী রীনা আক্তার শিশুদের নিয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি তার স্বামীকে ফেরত পেতে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন।
চুনারুঘাট উপজেলার তারাসুল গ্রামের মৃত আব্দুস সালাম মিয়ার ছেলে সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালিয়ে জীবন চালাতেন। গরীব কৃষক পরিবারের এই সন্তানকেই টার্গেট করে একই উপজেলার গণেশপুর গ্রামের নুর আলীসহ একটি দালাল চক্র। দক্ষিণ আফ্রিকায় লক্ষাধিক টাকা বেতনে চাকরির সুযোগ রয়েছে বলে তাকে লোভ দেখায় নুর আলী চক্র। সেই প্রলোভনে পা দেন সামাজুল। কথানুসারেই এক মাসের মধ্যে নগদ তিন লাখ টাকাসহ ভিসার জন্য পাসপোর্ট, ছবি নুর আলীর নিকট দেন তিনি। অতঃপর গত ১৮ মে নুর আলী তাকে জানান, সাউথ আফ্রিকার ভিসা হয়েছে। পরদিন ফ্লাইট। দ্রুত আরও দেড় লাখ টাকা দিতে হবে। এবার তাড়াহুড়া করে নিজের শেষ সম্বল সিএনজি অটোরিকশা বিক্রি করে দেড় লাখ টাকা তুলে দেন নুর আলীর হাতে। ১৯ মে বিকাল ৫টা ৫০ মিনিটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে একটি বিমানে তুলে দেয়া হয় সামাজুলকে। জানানো হয়, দুবাইয়ের শারজাহ বিমানবন্দরে দালাল চক্রের লোকজন তাকে গ্রহণ করবে। সেখান থেকে স্থলপথে সাউথ আফ্রিকা পাঠানো হবে তাকে। স্বজনরাও তাকে বিদায় জানালেন। সেই যে দেশ ছেড়ে গেলেন এরপর থেকে সামাজুলের কোনো খোঁজ পাচ্ছিলেন না স্বজনরা। দীর্ঘদিন তার কোনো হদিস নেই। দালাল নুর আলী, এই চক্রের সদস্য রাসেল মিয়া, রাকিব হাসান কেউ কোনো সন্ধান দিতে পারে না। দুশ্চিন্তায় পড়ে যান স্বজনরা। এভাবে প্রায় তিন মাস কেটে যায়। সামাজুল বেঁচে আছে কি-না, তাও জানেন না তারা। এ অবস্থায় বাড়িতে সামাজুলের এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার স্ত্রী অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটায় এবং কান্নাকাটি করেন।
গত ১৫ আগস্ট হঠাৎ করেই বড় ভাই তাজুল ইসলামের মোবাইলে কল দেয় সামাজুল। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সামাজুল। বলে উঠে ‘আমাকে বাঁচান। আমি এই জীবনে কখনও বিদেশের নাম নেব না। আমাকে এই জাহান্নাম থেকে রক্ষা করুন। আমাকে ওরা মেরে ফেলবে।’ ভাই আমাকে ওরা অন্ধকার প্রকোষ্টে বন্দি করে রেখেছে। মাঝে মাঝে টর্চার সেলে নিয়ে টাকার জন্য মারধোর করে। এভাবেই দেশে স্বজনদের কাছে বাঁচার আকুতি জানান বিদেশে দালাল চক্রের হাতে জিম্মিরা। প্রায় চার মাস যাবত জিম্মি তারা। রাখা হয়েছে টর্চার সেলে। এটি অন্ধকার ছোট একটি কক্ষ। সেখানে রাখা হয়েছে ১০ থেকে ১২ জনকে। রাত এলেই ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে দালালরা। একেকজন করে ডেকে নেয় আলাদা কক্ষে। তারপর কান্নায় ভারি হয়ে উঠে বাতাস।
বিদেশে-বিভূঁইয়ের এই কান্না চার দেয়ালেই আটকে থাকে। তবে দালালরা মাঝে-মধ্যে কান্নার শব্দ শোনায় দেশে থাকা স্বজনদের। কান্নার শব্দ শুনিয়ে দাবি করে টাকা। দাবিকৃত টাকা না দিলে হত্যা করার হুমকি দেয়। এখানেই শেষ নয় অত্যাচারের। মারধর ছাড়াও খাবার বন্ধ করে দেয়া হয়। খাবার নেই, পানি নেই। দিনে একবার, কখনও কখনও এক দিন পরপর নাম মাত্র খাবার ও পানি দেয়া হয়। খেয়ে না খেয়ে শরীর শুকিয়ে হাড্ডিসার।
এ ব্যাপারে সামাজুলের চাচা আঃ কদ্দুছ মানব পাচার ট্রাইব্যুনালে দালাল মোঃ নুর আলী, ট্রাভেলস মালিক রাকিব হাসান ও রাসেল মিয়াসহ অজ্ঞাত ৩/৪ জনের নামে মামলা দায়ের করেছেন। তিনি জানান, দক্ষিণ আফ্রিকার কথা বলে তাকে লিবিয়ায় আটকে রাখা হয়েছে। প্রতি রাতেই বেদম প্রহার করা হয় তাদের। চক্রের সদস্যদের দাবি একটাই, টাকা চাই। দেশ থেকে টাকা নিতে চাপ দিচ্ছে তারা। সামাজুলের কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করে চক্রটি। সামাজুল হাতে-পায়ে ধরে অনুনয় করেন। সামাজুল জানান, তিনি গরীব। তার মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই। সিএনজি অটোরিকশা চালাতেন। সেটিও বিক্রি করে দিয়েছেন বিদেশে যাওয়ার জন্য। এখন তার কিছুই নেই। তারপরও মন গলেনি দালাল চক্রের সদস্যদের। বরং টাকা না পেয়ে অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যায়। আগুন দিয়ে রড গরম করে ছ্যাকা দেয়া হয়। লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করা হয় তাকে।
এ খবর পেয়ে সামাজুলের বড় ভাই দরিদ্র তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা গরীব মানুষ। সামাজুল তার শেষ সম্বল বিক্রি করে সাউথ আফ্রিকা যেতে চেয়েছিলো। দালালরা প্রতারণা করে তাকে লিবিয়া নিয়ে বন্দি করে নির্যাতন করছে। তাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। এই অবস্থায় আমার চাচা মানব পাচার ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন। মামলা দায়েরের পর দালালরা আমার ভাইকে ছেড়ে দেবে বলে বার বার তারিখ করছে। কিন্তু এখনও সামাজুলকে ছাড়েনি। এ বিষয়ে সরকারের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন আটক সামাজুলের স্ত্রী রীনা আক্তার। রীনা আক্তার বলেন, আমার কোন অর্থ সম্পদ নাই, আমি আমার দুটি শিশু ছেলেমেয়ে নিয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিন যাপন করছি। আমি আমার স্বামীকে ফেরত চাই, আমি আর কিছু চাই না।