মতিউর রহমান মুন্না, নবীগঞ্জ থেকে ॥ নাম সততা স্টোর, এই স্টোরে নেই কোনো বিক্রেতা। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের খাতা-কলম, টিফিনের বিস্কুট, চকলেটসহ প্রয়োজনীয় অনেক কিছু এখানে পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীরা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দাম রেখে যায় ক্যাশ বাক্সে। এমনই ব্যতিক্রমী এক দোকান পাওয়া গেলো নবীগঞ্জ উপজেলার বড় শাখোয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মানুষকে বিশ্বাস করতে, বিশ্বাসী হতে, সর্বোপরি সততার শিক্ষা দিতেই এই বিদ্যালয়ে সততা স্টোরের উদ্যোগ নিয়েছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রুবেল মিয়া।
নবীগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল করগাঁও ইউনিয়নে অবস্থিত ‘বড় শাখোয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টিতে প্রবেশ করতেই দেখা গেল একটি কক্ষে লেখা রয়েছে সততা স্টোর। ওই স্টোরের কক্ষে সাজিয়ে রাখা হয়েছে খাতা, পেন্সিল, কলম, জ্যামিতি বক্স, সুইংগাম, চানাচুর, আচার, চকলেটসহ প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী। ওই স্টোরে ক্রেতা আছে, কিন্তু বিক্রেতা নেই। নেই সিসি ক্যামেরাও, নেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পণ্য কেনার পর ক্রেতারা দাম দিচ্ছে কি না সেটা নজরদারির কেউ নেই কারো। আত্মবিশ্বাসের ওপর চলছে এই সততা স্টোর। ন্যায্য মূল্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এখান থেকে কিনতে পেরে আনন্দিত শিক্ষার্থীরাও।
ওই বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী নিলা বেগম জানালেন, ‘আমি জিনিস কিনলাম, কেউ তো টাকা চাইলো না। যার কারণে আমি টাকা পরিশোধ করবো না, এ রকম মানসিকতা তৈরিই হয়নি আমার। এটাই আমি মনে করি শিক্ষা।’
আরেক শিক্ষার্থী নাদিরুজ্জান তুহেল বলেন, ‘এই সততা স্টোরে কোনো মালিক নেই। আমরা নিজেরা চাহিদামতো জিনিস ক্রয় করে টাকা ক্যাশ বাক্সে রেখে দিচ্ছি। এর মাধ্যমে আমরা সততার পরিচয় দিচ্ছি। একই মন্তব্যের সঙ্গে শিক্ষার্থী ফারহানা বেগম বলেন, সততা স্টোর থেকে পণ্য ক্রয়ের মাধ্যমে আমরা সৎ মানুষ হয়েই বড় হবো।’
প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি বাস্তব জীবনে শিক্ষার্থীদের সৎ ও আদর্শিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘সততা স্টোর’ চালু করা হয়েছে। এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগে স্থানীয়দের মাঝেও ব্যাপক সাড়া জেগেছে। বাস্তবমুখী এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে শিক্ষক ও অভিভাবকরা মনে করছেন দুর্নীতিমুক্ত নতুন প্রজন্ম গড়ার ক্ষেত্রে এটি ফলপ্রসূ হবে।
এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক ডাঃ কিরণ সূত্র ধর জানান, এটি একটি ভালো উদ্যোগ। শিক্ষকদের এই উদ্যোগের কারণে শিক্ষার্থীরা জীবনের শুরুতেই সন্তানেরা সৎ ও নিষ্ঠাবান হয়ে উঠবে।’
ওই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা রাশেদা বেগম বলেন, ‘সৎ চর্চার মধ্য দিয়েই আগামী দিনের সৎ মানুষ গড়ে উঠবে। তিনি জানান, প্রতিদিনই তার বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সততা স্টোর থেকে তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য কিনছে এবং রক্ষিত বাক্সে রেখে যাচ্ছে মূল্য।’
এই সততা স্টোরের মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে সৎ, আদর্শবান ও সুনাগরিক হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে মনে করে এই উদ্যোগের এই উদ্যোক্তা বড় শাখোয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষ সমিতির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ রুবেল মিয়া বলেন, এই সততা স্টোর- সততা চর্চার একটি প্লাটফর্ম। এটি একটি প্রতীক। সততা চর্চার উদ্দেশ্যেই মূলত এই ‘সততা স্টোরের যাত্রা। ভবিষ্যত প্রজন্মকে সততার চর্চা করানোর জন্য, দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব তৈরি করার জন্য সততা স্টোর চালু করা হচ্ছে। যাতে ছোট শিক্ষার্থীরা নিজেরা সৎ থাকে। ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত সততা শিক্ষা দেওয়া হলে এ কাজের মাধ্যমে তাদের স্বচ্ছ মানসিকতা গড়ে উঠবে বলেও মনে করেন তিনি।
নবীগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা প্রঞ্চাণন কুমার সানা বলেন, সততা স্টোরের মাধ্যমে শিশুদের নৈতিকতার সুষ্ঠু চর্চায় শিশুদের আগ্রহী করতে এমন উদ্যোগ প্রশংসনীয়। শিশুরা তাদের নৈতিক চর্চা মধ্যমে যাতে সফল নাগরিক হতে পারে এজন্য দেশের সকল স্কুলে এই উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলেন তিনি।
ক্রেতা আছে, বিক্রেতা নেই
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com