ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
শুধু শিক্ষিত হলেই যেমন জ্ঞানী হওয়া সম্ভব নয় আবার শিক্ষিত না হয়েও অনেক জ্ঞানী ও গুণীজন সমাজে যথারীতি বিদ্যমান। অনেক স্বল্প শিক্ষিত ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের নিকটেও অনেক সময় বহু উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিকে হার মানতে নজরে পড়ে। নীতি-নৈতিকতায়, সততায়, আচার আচরণে বহু অশিক্ষিতজন সমাজে সম্মানের সাথে সমাদৃত। তবে এট ঠিক যে, ‘শিক্ষা মানুষকে বিনয়ী করে, বুদ্ধি মানুষকে উন্নত করে, শিক্ষা এবং বুদ্ধির সম্মিলন মানুষকে মহান করে’। আবার অনেকে পারিবারিক, সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক সুশিক্ষা লাভ করে স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত হয়ে উঠেন।
যা বলছিলাম, বড় চাচাকে আমি শিশুকাল থেকেই দেখে এসেছি। তেমন লেখাপড়া নেই কিন্তু ব্যক্তিত্ব, দায়িত্ববোধ, ক্ষুদ্র পরিসরে উনার বলিষ্ট নেতৃত্ব, প্রয়োজনবোধে ত্বড়িৎ গঠনমূলক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ছিল লক্ষ্যণীয়। গেল ক’দিনে তা আরো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেলাম। হয়ত নিজের প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা অর্জনের সাথে সাথে এ পারিবারিক শিক্ষাও জীবনে অনেক কাজে লেগেছে। তাছাড়া একান্নবর্তী পরিবারের পারস্পরিক সম্পর্ক, দায়িত্ববোধ, জীবনধারা ছোট বিচ্ছিন্ন পরিবার থেকে নিঃসন্দেহে ভিন্নতর। একান্নবর্তী পরিবারে বড় হলে সার্বজনীন একটা চিন্তাচেতনার জন্ম হয়। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন তৈরি হয় স্বার্থপরতার বিপরীত ধারায়। নিজের জীবনে এ বৈপরীত্যটুকু কিছুটা ধরে রাখতে পারলেও পরবর্তী প্রজন্মে তা অনেক হ্রাস পেয়েছে নির্দ্ধিধায়। একারণেই একান্নবর্তী পরিবারের প্রয়োজন পশ্চিমা সভ্যতা আজ হারে হারে উপলব্ধি করছে।
দুপুরে খাওয়ার পর চাচা কিছুক্ষণ ঘুমাতে বললেন। যখন ঘুম ভাংল সূর্য তখন পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে।
আমার খাওয়া-দাওয়া, গোসল, চালচলন, আহ্লাদ-আবদার, নৌকার বাকি শরীকদের সাথে চলাফেরা ও আচার আচরণের মাপকাটি কেমন হবে তা উনার স্নেহমমতার ভিতর দিয়েও অদৃশ্যভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছিলেন। এক কথায় উনার দৃষ্টিতে মেধার পরিচর্যার কোনরূপ ত্রুটি করছিলেন বল মনে হয় না। জীবনের বয়োঃসন্ধিক্ষণে বুদ্ধিবৃত্তির পরিপক্বতা বৃদ্ধির সাথে সাথে আমিও নিঃসন্দেহে তা কিছুটা বুঝতে সক্ষম হচ্ছিলাম বৈ কি।
চাচা জানালেন আমাদের গন্তব্যস্থানে পৌঁছুতে আর হয়ত ঘণ্টা দু’এক লাগবে। মদনগঞ্জে ধানের অনেকগুলো আড়ত আছে, শতাধিকতো হবেই। আচার ব্যবহার, লেনদেনের উপর নির্ভর করে একেক বেপারির একেক আড়তের প্রতি বিশেষ পছন্দ অপছন্দ আছে। মদনগঞ্জে আমাদের নৌকার সুনির্দিষ্ট আড়ত হল আষ্ট তহবিল। অর্থাৎ আটজনে মিলে ব্যবসা খুলেছেন। এমনি করে পাঁচ তহবিল, দশ তহবিল বা ব্যক্তির নামেও আছে, যা পৌছার পর আমার নজরে পড়েছিল।
হঠাৎ একজন লোক একটা ছোট ছইওয়ালা নৌকা থেকে আমাদের নৌকায় লাফ দিয়ে উঠে উনার নৌকাটা একটু দূরে সরিয়ে দিলেন। মনে হল চাচার পরিচিত, বাড়ি আমাদের জেলাতেই। কথাবার্তায় মনে হল কোন বিশেষ আড়ত থেকে এসেছেন, চাচাকে অনুনয় বিনয় করে উনার আড়তে নিতে চাচ্ছেন। যদি অন্য কোন আড়তের লোকজন জানতে পারে এভাবে পথ থেকে রাজি বা জোর করে উনাদের এখানে নিয়ে যাচ্ছেন তাহলে জরিমানার নিয়ম করা আছে। জানলাম তারও একটা কারণ আছে। বিভিন্ন আড়ত থেকে কিছু কিছু বেপারিকে অগ্রিম পুঁজি বা চালান দেয়া হয় যাকে দাদন বলে। তাই একজনের নৌকা নিয়ে অন্যজনের টানাটানি তাদের নিয়মে নিষিদ্ধ। কিছুক্ষণ পর ভদ্রলোক নেমে গেলেন এবং লুকোচুরির কারণও বুঝা গেল।
‘দাদন’ পদ্ধতির কিন্তু উত্তরোত্তর প্রসার ঘটেই চলেছে। এখন ধান, পাট, মাছ, সব্জি, ফুল সকল ব্যবসায়ই মধ্যস্বত্বভোগীদের মহাজনেরা তথা আড়তদারগণ অগ্রিম কিছু পুঁজি সরবরাহ করে করায়ত্ত করে ফেলেন। লাভ কম হলেও দাদনদাতাকে ঐসব মহাজনদের কাছেই মাল সরবরাহ করতে হয়। এভাবে মহাজনেরা মোটামুটি একটা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। সূতরাং এক ঘর হতে ব্যবসায়ীরা স্থানান্তর হওয়া দুরূহ ব্যাপার। ফলে উৎপাদনকারীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
আমি চতুর্থ/পঞ্চম শ্রেণীতে থাকাকালীন দেখতাম ভাটি অঞ্চলের বিভিন্ন আড়তের মালিকগণ বর্ষার পূর্বে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন, সৌজন্যমূলক সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে। ১৯৭২/৭৩ সালে মতলবের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জনাব আবদুল গণি মাস্টার এম,এ বেড়াতে আসলে পাশে বসে খাওয়াতাম। মনে আছে একজন ভাল ছাত্র মনে করে আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। উনার ওখানে যাওয়ার দাওয়াতও দিয়েছিলেন। আজকাল মহাজনদের এ ধরণের বেড়ানোর আর প্রয়োজন পড়ে না। দাদন পদ্ধতি সামাজিক ও আন্তরিক এ বন্ধনটাকে ছিহ্ন করে দিয়েছে। আবেগ ভালবাসা আজ অর্থের করতলগত। সত্যি আজ ‘অর্থই সকল অনর্থের মূল’।
চলবে…..