এসএম সুরুজ আলী ॥ আনন্দের নাই সীমা। যেদিকে থাকাই দেখি আমি দুই নজরে ডিজিটাল বাংলার ঘরে ঘরে। ল্যাপটপ কম্পিউটারে ডিজিটাল পদ্ধতি। যে জন যারে দেখতে চায়, ইনি টাইম দিনরাত্রী। ডে নাইট অবিরত ইন্টারনেট মনের মতো। লাইন লাগাইয়া সংযোগ করে ডিজিটাল বাংলার ঘরে ঘরে। সরকারের এমন উন্নয়ন কর্মকান্ড নিয়ে এই গান লেখাসহ অসংখ্য গানের গীত রচনা, সুর করে নিজে কন্ঠে গেয়েছেন বানিয়াচঙ্গের জনপ্রিয় বাউল শিল্পী শাহ মোজাহিদ আলম। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে গান লিখেছেন। অসংখ্য গানের রচয়িতা ও গান নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকলেও বাউল শিল্পী মোজাহিদ আলমের সংসার জীবন অনেকটা অভাব অনটনের মধ্যে কাটছে। এ অবস্থায় তিনি তার সন্তানদের লেখাপড়া করাতেও হিমশিম খাচ্ছেন। আগের মত বাউল গান না হওয়া ও কোথাও বাউল গান হলেও সেখানে পুরুষ শিল্পীদের চাহিদা থাকে না। মহিলা শিল্পীদের চাহিদা বেশি থাকে এ কারণে শাহ মোজাহিদ আলমসহ জেলার অসংখ্য বাউল শিল্পীদের মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় বাউল শিল্পীদের সংসার জীবন কাটছে কষ্টের মধ্যে। এর বাইরে মোজাহিদ আলমও নন। তবে প্রত্যেক বাউল শিল্পীর সংসার জীবনের দিকে থাকালে এমন চিত্রই দেখা যায়। বাউল শিল্পী মোজাহিদ আলম বানিয়াচং উপজেলা সদরের মজলিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার বাবার নাম আবু ইউসুফ আলী। ৬ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তিনি ২য়। তিনি প্রাইমারী স্কুলে ৩য় শ্রেণীতে লেখাপড়ার সময় গান গাওয়া শুরু করেন। পাশাপাশি গান লেখাও শুরু করেন। এক পর্যায়ে কামালখানীর মাস্টার এনামুল হকের কাছে তিনি গান শিখেন। তার কাছ থেকে দুয়েক বছর গান শেখার পর তিনি মহারতœ পাড়ার তাপস কৃষ্ণ মহারতেœর কাছে গানের তালিম নেন। মূলত তার কাছ থেকে তালিম নিয়ে পুরোদমে গানের জগতে পদার্পণ করেন মোজাহিদ। হবিগঞ্জ জেলাসহ বিভিন্ন স্থানে বাউল গানের আসরে গিয়ে গান পরিবেশন করেন তিনি। শুধু বাউল গানই নয়, সরকারি বিভিন্ন দিবসের অনুষ্ঠানেও তিনি মঞ্চে গান পরিবেশন করেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের গানের অনুষ্ঠানে গান গাওয়া হয় মোজাহিদ আলমের। এর মধ্যেই তিনি ২০০৩ সালে পারিবারিকভাবে মিয়াখানী গ্রামের খদাবক্স উল্লাহ’র মেয়ে মাহমুদা আক্তারকে বিয়ে করেন। মাহমুদা আক্তার স্থানীয় ব্র্যাক স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তার গর্ভে নেয় মোজাহিদ আলমের ১পুত্র ও ১কন্যা সন্তান। মোজাহিদ আলমের কন্যা মুর্শেদা আক্তার জ্যোতি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯ম ও ছেলে শাহ মুক্তাদীর মেহেদী ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে লেখাপড়া করছে।
দাম্পত্য জীবনে সুখ ভালবাসার অভাব না থাকলেও পরিবার চালাতে মোজাহিদের রয়েছে অর্থনৈতিক অভাব। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তিনি তার সন্তানদের ভালভাবে লেখাপড়া করাতে পারছেন না। এ অবস্থায় সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে তিনি সব সময় থাকেন দু:শ্চিন্তায়। জীবন ও যৌবনের অধিকাংশ সময় সংগীতের মাঝে কাটিয়েছেন মোজাহিদ আলম। সংসার জীবনের কোনদিন চিন্তা করেননি তিনি। যখন সংসার জীবনের চিন্তায় পড়েছেন, তখন এর কোন দিকই খোঁজে পাচ্ছেন না। কখন মৃত্যু আসে, আর কখন তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। আর মৃত্যুর পর কিভাবে চলবে তার পরিবার। সন্তানদের জন্য তিনি কি রেখে যাবেন। এসব চিন্তা এখন সব সময় মোজাহিদ আলমকে তারা দিচ্ছেন।
মোজাহিদ আলম গীতিকার ও সুরকার হিসেবে প্রথম এ্যালবাম মনে শান্তি নাই প্রকাশ করেন ২০০৭। তার লেখা গান হবিগঞ্জের বাউল শিল্পী প্রাণকৃষ্ণ, মোশ^াব্বির আহমেদ তান্নান, হরিপদ, মাধবপুরের জগদীশপুরের রহিমা, নবীগঞ্জের নিউ শাহানা, ময়মনসিংহের রোকেয়া, শাহবাজপুরের হারুনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের শিল্পীরা গেয়েছেন। যখন শিল্পীরা তার লেখা গান গেয়েছেন তখন বাজারে অডিও, সিডি, ভিসিডি ক্যাসেটগুলো প্রচুর বিক্রি হতো। অনেক ভক্ত তাদের পচন্দের শিল্পীদের গাওয়া গানের নতুন ক্যাসেট খুঁজে নিতেন দোকানগুলো থেকে। কিন্তু ৮/৯ বছর ধরে বাজারে অডিও, সিডি, ভিসিডি’র কোন ক্যাসেট বিক্রি হচ্ছে না। ক্যাসেটের দোকানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। বাউল শিল্পী মোজাহিদ আলমেরও ক্যাসেটের দোকান থাকলেও তার দোকানটি বন্ধ হয়ে গেছে। ক্যাসেট দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে আগের তুলনায় এখন শিল্পীদের জন্য নতুন গান তৈরী হয় খুব কম। মানুষ ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। এ পদ্ধতির কারণেই ইউটব থেকে গানগুলো ডাইনলোড করে মোবাইলের মেমরীতে নিয়ে দেখছেন। একবার ৪০/৫০টাকা দিলে কম্পিউটারের দোকান থেকে অনেক গান, ছায়াছবি, নাটক মেমরীতে নিতে পারছেন। আর কোন অনুষ্ঠানে কিংবা টেলিভিশনে কোন শিল্পী গান পরিবেশন করলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। তখন ঘরে বসে গানগুলো ভক্ত ও সংগীত প্রেমীরা দেখতে পারেন। এসব কারণে অডিও সিডিও ভিসিডির ব্যবসায় ধ্বস নামে। ক্যাসেটের বাজারে ধ্বস নামার ফলে সংগীত প্রেমীরা শিল্পীদের নতুন গাওয়া গান খুবই কম শুনতে পান। টেজ শো, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেলে দেখা যায়, একই গান গাচ্ছেন। তাদের মধ্যে নতুন কিছু পাওয়া যায় না। এছাড়াও মঞ্চ অনুষ্ঠানে পুরুষ শিল্পীরা গান গাইতে গেলে তাদের গান দর্শকরা শুনতে চান না। দর্শকদের চাহিদা থাকে মেয়ে শিল্পীদের প্রতিই। কারণ পুরুষ শিল্পীদের এখন দূরবস্থা।
বাউল শিল্পী মোজাহিদ আলমের সাথে এ প্রতিনিধি আলাপ হলে তিনি জানান, মা, মাটি, দেশ ও সংগীতকে ভালবেসেই এ জগতে এসেছিলাম। এসে দর্শকদের অনেক ভালবাসা পেয়েছি। পারিবারিক জীবনে আমার বাবার জায়গা-জমি তেমন নেই। তবে দেওয়ান মাহবুব রাজার ভাতিজা দেওয়ান আহমদ জুলফিকার নাইনের কাছে সহযোগিতা চাইলে তিনি নামকাওয়াস্তে টাকা নিয়ে কিছু জায়গা আমাদের কাগজ করে দিয়েছিলেন। এছাড়া আর কোন জায়গা, জমি তার নেই। তিনি বলেন- অসংখ্য গান লেখার পর ১০ বছর পূর্বে সিলেট বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার হিসেবে স্বীকৃতি পান। তিনি বলেন- শুধু আমি নই, আমার মত এখন যারা বাউল শিল্পী রয়েছেন তাদের সকলের দিনকাল ভাল যাচ্ছে না। যেসব বাউল শিল্পী বয়সের ভারে বৃদ্ধ হয়েছেন তাদের আর গানের অনুষ্ঠানে কেউ আমন্ত্রণ দেন না। আর আমাদের মত যারা ৩৫/৪০ বছরের ভিতরে রয়েছি, তাদের গানের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ দিয়েও অল্প টাকা সম্মানী দেন। বাউল গানের মঞ্চে উঠলে দর্শকরা পুরুষ শিল্পীর গান শুনতে চান না। পুরুষ শিল্পীরা গান ভাল গাইলেও তাদের কোন টাকা পয়সা উপহার হিসেবে দেয়া হয় না। মেয়ে শিল্পীরা মঞ্চে উঠে গান গাওয়া শুরু করলেই এক শ্রেণীর দর্শকরা তাদের টাকা দেয়া শুরু করেন। শিল্পীরাও টাকা নেয়ার জন্য অমুক তমুক বলে ৫মিনিটের গান ১০/১৫ মিনিট সময় নিয়ে গেয়ে শেষ করেন। তিনি বলেন- বর্তমানে আগের তুলনায় বাউল গানের অনুষ্ঠানও অনেকটা কমে গেছে। আগে যে হারে বাউল গান হতো, এখন হবিগঞ্জ জেলায় সেই হারে বাউল গান হয় না। তিনি বিভিন্ন স্থানে বিয়ের গায়ে হলুদ, সামাজিক সংগঠনের আয়োজিত সংগীতানুষ্ঠান ও সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে গান পরিবেশন করেন। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে পরিচিত লোকজনদের গানের অনুষ্ঠানে গেলে তারা অনেক সময় সম্মানী দেন। আবার অনেক সময় সম্মানী দেনও না। এ অবস্থায় সংসার চালানো অনেকটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরও বলবো, আমার গানই জীবন, গানই আমার সাধনা। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গান গেয়ে যেতে চাই। টেলিভিশনে গান গাওয়া আমার দীর্ঘদিনের শখ। জানি না, জীবনে সেই আশা পূরণ হবে কি-না। তবে আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। তিনি বলেন- বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের অনেক উন্নয়ন করেছেন। তিনি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দরিদ্র শিল্পীদের সহযোগিতা করছেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন নিয়ে গান লেখেছি এবং গানটি সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ ইউটিউবে প্রচার হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলা ঘরে ঘরে এই শিরোনামে গান করেছি। ভবিষ্যতে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড নিয়ে আরো গান লেখতে ও গাইতে চাই। গানগুলো প্রচারের জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি। এছাড়াও ছেলেমেয়েদের সু-শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য সরকারের সহযোগিতা চান শিল্পী মোজাহিদ।