ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
(এক)
অক্টোবর, ১৯৭৩ইং। এসএসসি পরীক্ষা সবেমাত্র শেষ। টানা দেড়-দু’বছর কঠোর পরিশ্রমের পর তিন মাসের কাক্সিক্ষত বিশ্রামের এইত সুবর্ণ সুযোগ। তখন কোচিং পদ্ধতি ছিল না, সুতরাং পরীক্ষার পূর্বেই কলেজে ভর্তি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ তিনমাস উপভোগ করার উপায় নিয়ে কত যে স্বপ্ন আঁকা হয়েছে হিসেব নেই। আবার এও ভেবেছি, তিন মাস কোন লাইব্রেরির সাথে ভাব জমিয়ে সারাদিন বই পড়ার একটা সুযোগ করে নিব। অথবা সকল আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে ইচ্ছামত বেড়ানো যাবে যতদিন খুশি। সুযোগতো আর খুব একটা আসে না, অমানুষিক পরিশ্রমের পর ইচ্ছামত তিনটা মাস ঘুমিয়ে গড়িয়ে কাটালেও মন্দ হয় না। বর্ষার শেষদিকে ভাটি অঞ্চলে ভাসমান পানি কমতে শুরু করে, তখন মাছ ধরা পরে বিপুল পরিমাণে। তাই বাড়ির সমবয়সী ভাই, চাচাদের নিয়ে বিভিন্ন কায়দায় মাছ ধরলেও মন্দ হয় না। যদি ভাগ্যের ফেরে ভবিষ্যতে পড়াশোনা করে কিছু একটা হয়ে যাই তাহলে ভবিষ্যতে মাছ ধরার সুযোগ হয়ত আর খুব একটা পাওয়া যাবে না। কিশোর মনের হাজারো স্বপ্ন এমনিভাবে ঘুরপাক খাচ্ছিল অলস মনে।
তখনকার সময়ে আমাদের স্কুলের লাইব্রেরী যথেষ্ট সমৃদ্ধ থাকায় পছন্দমত অনেক বই পড়ার সুযোগ হয়েছে লাইব্রেরীর দায়িত্বে থাকা আফিল উদ্দিন স্যারের বদৌলতে। তাই এ নেশায় পরীক্ষার পরপরই নতুন বের হওয়া শরৎ রচনাবলীর দশ খন্ড একসঙ্গে কিনে নিলাম।
তখন আমাদের পাঁচশত মণি একটা বড় ধানের নৌকা ছিল। বড় চাচা ছিলেন এর পরিচালক তথা বেপারি। চাচা আমাকে যারপরনাই আদর করতেন। বাবা বা অন্য চাচাদের নিকট কোন কাজে অকৃতকার্য হলেও বড় চাচার কাছে ব্যর্থ হয়েছি এরকম নজির মনে পড়ে না।
উজান থেকে ধান বোঝাই দিয়ে বিক্রির উদ্দেশ্যে ভাটিতে যাওয়ার পূর্বে নৌকা ঘাটে নোঙর করা। তিন চারদিন পর বিক্রির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে ভাটির দিকে। ঐ সময়ে ইঞ্জিন সিস্টেম না থাকায় বেয়ে বা পালে সব মিলিয়ে মতলব, হাজীগঞ্জ, মদনগঞ্জ অথবা ঢাকার কাটপট্টি এসব জায়গায় পৌছুতে তিন চারদিন সময় লাগত। বর্ষার শেষদিক, শরতের ঢেউহীন প্রায় শান্ত নদী এবং হাওরের বিস্তীর্ণ জলরাশি। প্রকৃতির এ অপরূপ দৃশ্য দেখে হঠাৎ মনে হল চাচার সঙ্গে নৌকায় শরৎ রচনাবলী সমেত ভ্রমণে বের হলে মন্দ হয় না। চাচাকে বলতেই রাজি হয়ে গেলেন। বাড়ির সবাইকেও রাজি করালাম। আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম এই ভেবে একটানা আট দশদিন নৌকায় কাটাব তৎসঙ্গে বইগুলোও পড়া যাবে। ফেরার সময় জীবনের প্রথম রাজধানী ঢাকা ঘুরে আসব, কি মজা! আমার আনন্দ দেখে কে?
যথারীতি সীমিত কাপড়চোপড় ও বইগুলো সহ একদিন সকালে ফজরের নামাজের পর মিলাদ শেষ করে শরতের শান্ত সকালে যাত্রা শুরু হল। কলম্বাসের মতই এক অনুপম উল্লাস মনে ধারণ করে যেন আমেরিকা জয়ের উদ্দেশ্যে নৌকার গলুইয়ে পা রাখলাম। বাড়ির ছোটবড় সকলে ঘাটে দাঁড়িয়ে বিদায় দিচ্ছিলেন। সাথে এটলাস তথা মানচিত্রের বইটাও নিলাম। নদীর গতিপথ অনুসরণ করে করে তীরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো সম্বন্ধে একটা ভাল ধারণা নেয়া যাবে। নৌকায় আরো ছয়জন শরীক আছেন। রকম আলী মামু, নাদু চাচা, দরছ ভাই সহ আরো তিনজন। আমি উনাদের সফরসঙ্গী হওয়াতে সবাই খুব খুশি। বাড়িতে থাকলে উনাদের লাভ-লোকশান, ভাংতি (খরচের হিসাব), বেপারীর অতিরিক্ত শতকরা ৫% দপ্তরী সহ নৌকার যাবতীয় হিসেব কিতেব নিখুঁতভাবে করার দায়িত্বটা পড়ত আমার উপর। ফলে উনাদের মাঝে আমার অন্যরকম একটা কদর ছিল। ঐ সময় ক্যালকুলেটর না থাকায় সব যোগ বিয়োগ ভাগ পূরণ হাতেই করতে হত। দ্বিতীয়ত উনাদের সঙ্গে বাড়ির ছোট মহাজন যাচ্ছেন এ যেন এক সাংঘাতিক ব্যাপার।
নৌকার শরীকদের মাঝে যিনি একটু লেখাপড়া জানেন তিনি হলেন তহবিলদার অর্থাৎ টাকা পয়সার হিসেব রাখেন আর জমা খরচ ও ভাংতি খাতায় লিখে রাখেন। টাকা পয়সার দায়িত্বও উনার নিকটই থাকে। রকম আলী মামু পাক করতে পারতেন ভাল, সুতরাং তিনি হলেন বাবুর্চি। প্রথম দিন নাছিরনগরের চুন্ড্রার হাওর পাড়ি দেয়ার পালা। মোটামুটি বড় হাওর। মাঝেমধ্যে ডাকাতেরা নৌকা আটকে কোন উঁচু ঢিবিতে নিয়ে গিয়ে ধান লুট করে নেয়। একবার এ চাচাই নৌকার বেপারি থাকা অবস্থায় আমাদের ধানের নৌকা ডাকাতি হয়েছিল। তখন আমি দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। পরদিন খালি নৌকা নিয়ে ঘাটে ফিরে সবাই যখন মলিন মুখে বসেছিলেন সে দৃশ্য আজো মনে পড়ে। তাই এই চুন্ড্রার হাওরের ইতিহাস, ভৌগলিক অবস্থান আমার নখদর্পণে।
আমাদের সন্ধ্যা হল আশুগঞ্জের কাছাকাছি ‘পানিশ্বর’ নামক স্থানে। গ্রামের ভিতরে একটু আড়ালে যেখানে ঢেউ, বাতাস নেই আরো আট দশটা নৌকা এসে ভিড়তে থাকল ধীরে ধীরে। নৌকা রাখার এ স্থানগুলোকে ‘খাড়ি’ বলা হয় এবং যাত্রাপথে কোথায় কোথায় এসব নির্দিষ্ট খাড়ি আছে তা সবারই জানা। কারো সঙ্গে কারো তেমন পরিচয় না থাকলেও কিছুক্ষণের মধ্যে সব নৌকার লোকজনদের মাঝে সহজাত গল্পের আসর জমে উঠল। কোন কোন নৌকা থেকে ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, শেখ ভানু শাহ’র পুথি পড়ার সুর কানে আসতে লাগল। দারুণ মজা পেতে লাগলাম। ছই এর বাহিরে আমার স্পেশাল বিছানা পেতে টাটকা অথচ সুস্বাদু মাছ, ডাল, দুধ কলা দিয়ে মেহমানদারি খানা শেষ করে রাত ন’টার পূর্বেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন কাকডাকা ভোরে সবাই উঠে যাত্রার প্রস্তুতি শুরু করলেন, কেউ কেউ নামাজ পড়লেন। সূর্য উঠার আগেই সাড়ি বেঁধে বড় বড় নৌকা মেঘনায় নেমে পড়ল। সূর্য উঠার সময়ে নদীর দুকূলের অপূর্ব সৌন্দর্য্য ছিল দারুণ! দলবেঁধে হিন্দু মহিলাদের প্রাতস্নান, কলসী কাঁকে ঘরে ফেরা, জেলেদের বিভিন্ন রকম জাল দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্যগুলো বাস্তবে উপলব্ধি করার মত। কিছুক্ষণ পর ভৈরব রেলওয়ে ব্রীজ (পুল) যা আগে কোনদিন দেখিনি প্রথম চোখে পড়ল। এ নিয়ে দাদীর কাছ থেকে অনেক কল্প কাহিনী শুনেছি। বৃটিশরা প্রথম পুল তৈরির সময় মাঝখানে পিলার দাঁড় করাতে পারছিল না। বড় ইঞ্জিনিয়ার স্বপ্নে দেখলেন নদীতে একশত একখানা নরমুন্ড দান করতে হবে নচেৎ পিলার দাঁড় করানো সম্ভব নয়। শুরু হল ছেলেধরা (খোঁজকর) দিয়ে মানুষ খোঁজা। খোঁজকরেরা কমলা দেখিয়ে দেখিয়ে ছেলেদের ধরে নিয়ে যেত। এমনি করে একশত একটা নরমুন্ড দান করার পর ব্রীজটা করা নাকি সম্ভব হয়েছিল। দুুু’শতাধিক বছর যাবৎ চলমান এ কল্পকাহিনী দাদীর নিকট থেকে আমিও শুনেছিলাম। তাই ব্রীজটা দেখার পর পরই শরীর মন শিউরে উঠল।
চলবে…