মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ রাজনৈতিক দলসমূহের নির্বাচনী ইশতেহারে দলিত ও সংখ্যালঘুদের জন্য দেয়া প্রতিশ্রুতি কেবলমাত্র প্রতিশ্রুতি শব্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। নির্বাচনে জয়লাভের পর তা বাস্তবায়নে কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না। বাস্তবতা হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো সংখ্যালঘুদের ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের ফায়দা হাসিল করে। এভাবেই দিনের পর দিন দলিত ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠি নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে।
হবিগঞ্জ শহরের রাজনগর এলাকার বাসিন্দা নারায়ন রবিদাস বলেন, দলিত সম্প্রদায়ের মূল্যায়ন হয় শুধু নির্বাচনের পূর্বে। নির্বাচনের পর আমাদের কোন মূল্যায়ন হয় না। নির্বাচনী ইশতেহারে যারা আমাদের কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দেন তা শুধু প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ থাকে। বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটে না। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, রাজনগর রবিদাস পাড়ার অধিবাসীরা অত্যন্ত গরীব। তাদের মতো দরিদ্র শহরের অন্য কোন পাড়ায় আছে কি না তা আমার জানা নেই। তারা সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানুষিকভাকে কতটা অবহেলিত তা স্বচক্ষে না দেখলে অনুধাবন করা সম্ভ নয়। সমাজে আমাদের কোন মূল্যায়ণ নেই। অথচ এই সমাজ উন্নয়নে আমাদের অবদান অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। আমারা আমাদের মর্যাদা চাই। আমাদের ন্যায় সঙ্গত অধিকারের বাস্তবায়ন চাই।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, নির্বাচনের পূর্বে রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের উন্নয়নে কথার ফুলঝুড়ি ছড়ালেও নির্বাচনের পর আর তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রতিশ্রুতি শুধু প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ থাকে, বারবার তাদের কাছে আবেদন নিবেদন করেও কোন ফল পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ হবিগঞ্জ জেলা শাখার সহ-সভাপতি ত্রিলোক কান্তি চৌধুরী বিজন বলেন, দলিত এবং সংখ্যালঘুদের জন্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে ভোটপ্রাপ্তির বিষয়টি বাদে আর কোন আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। বাস্তবতা হচ্ছে একটি রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘুদের ভোট ব্যাংক মনে করে। আবার সংখ্যালঘুদের জায়গা জমি বা সম্পদ দখলে নেয়ার সময়ও এই রাজনৈতিক দলেরই উৎসাহ থাকে বেশি। অপরদিকে অপর একটি রাজনৈতিক দল জামাতের সাথে থাকায় তাদের প্রতি সংখ্যালঘুদের আস্থা নেই। সংখ্যালঘু নির্যাতনে এদেরও আগ্রহ বা উপস্থিতির কোন কমতি নেই। তাছাড়া সংখ্যালঘুদের মাঝে অভ্যন্তরিন কিছু দূরত্ব থাকায় নিজেরা মিলিতভাবে একটি প্লাটফর্মে এসে কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না। অপরদিকে ভারত সরকার সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দুর্বল চিত্তের সংখ্যালঘুদেরকে ভারতে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করছে। প্রকৃত অর্থে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার জন্য দেশে কার্যকর কোন আইন নেই। সংখ্যালঘুরা অত্যাচারিত হলেও বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলমান। যে কারণে সংখ্যালঘুরা সব সময় আতংকিত অবস্থায় থাকে। যাদের স্বচ্ছলতা আছে তারা সকলেই ছেলে মেয়েকে বিদেশ পাঠিয়ে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে। আর যাদের স্বচ্ছলতা নেই তারা আপোষ করে অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে কষ্টগুলো বুকে চাপা দিয়ে এদেশেই থেকে যায়। আবার কেউ সুযোগ বুঝে ভারতবাসী হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংখ্যালঘুদের নেতা হওয়া খুবই দুরূহ। সকল রাজনৈতিক দলই কমবেশি তাদেরকে অলংকার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। বাস্তবিক অর্থে যদি কারো যোগ্যতাও থাকে দলীয় টিকেট পাওয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায় তার দাবি অগ্রহণযোগ্য হয়। এতে হতাশার সৃষ্টি হয়। এই হতাশাই সংখ্যালঘুদের ধীরে ধীরে মরার প্রথম পাঠেয়। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে সকলেই অতি সহজে সবকিছু জানতে পারেন। দেখা যায় এমন একটি দিন নেই যেখানে দেশের কেথাও না কোথাও সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়নি। তাই সংখ্যালঘুদের দেয়া প্রতিশ্রুতি কেবলমাত্র প্রতিশ্রুতি শব্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর বাস্তবায়ন কখনোই হবে বলে মনে হয় না।
হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আলমগীর চৌধুরী বলেন, আমাদের সমাজে দলিত সংখ্যালঘুরা সত্যিই অবহেলিত। তারা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। রাজনৈতিক দলসমূহ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দলিত সংখ্যালঘুদের জন্য নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। কিন্তু নির্বাচনে জয়লাভের পর তা বাস্তবায়নে কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার সব সময় দলিত সংখ্যালঘুদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে বর্তমানে তার সুযোগ্য কন্যা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলিত সংখ্যালঘুদের কল্যাণে নানা কল্যাণমুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তিনি বিশ^াস করেন সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠিকে বাদ দিয়ে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই দেশের উন্নয়ন করতে হলে আগে তাদের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় উপজেলার গন্ধ্যা, মিলনগঞ্জ বাজার ও নদীর তীরবর্তী এলাকায় বসবাসকারী ছিন্নমূল ও ঋষী সম্প্রদায়ের কল্যাণে কাজ করেছেন। অধিকার নিশ্চিতে তাদের জন্য সৌরবিদ্যুত, উন্নত আবাসন ব্যবস্থাসহ স্যানিটেশন ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করেছেন। চা জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়নে স্যানিটেশন, সুপেয় পানি নিশ্চিতে গভীর-অগভীর নলকূপ স্থাপন, শীতকালে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছেন। যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার। এছাড়াও দলিত সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে প্রায় ২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন যা দিয়ে শ্মশানঘাট, মঠ, নাট মন্দির, রথ নির্মাণ ও মেরামত করা হয়েছে। নির্বিঘেœ প্রতিমা বিসর্জন দেয়ার জন্য ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে ঘাটলা নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া উপজেলার পাঞ্জারাই ও বোয়ালজোর গ্রামে অবৈধ দখলে থাকা দেবোত্তর সম্পত্তি উদ্ধার করে প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। এটি তার অন্যতম সাফল্য হিসেবে মনে করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দলিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সমাজে সবসময় বঞ্চিত, অবহেলিত ও উপেক্ষিত। আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে আমি সব সময় চেষ্টা করেছি তাদের জন্য কিছু করতে। ব্যবসা বানিজ্যে সম্পৃক্ত করে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে। কারণ তারা প্রতিষ্ঠিত না হলে, তাদের জীবনমান উন্নত না হলে, তাদের বসতবাড়ি না থাকলে একদিন তাদের অস্থিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। তাদের অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে তাদের আবাসন, উন্নত স্বাস্থসেবা নিশ্চিকরণসহ জীবনমান উন্নয়নে রাজনৈতিক দল সমূহকে নির্বাচনী ইশতেহার এবং প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে আরো আন্তরিক হতে হবে।