তাহমিনা বেগম গিনি
চারটি নামই নারীর নাম। বর্তমান বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত, সমালোচিত নারী এই চারজন। প্রতি জন ভিন্ন ভিন্ন কর্মের জন্য সুপরিচিত। এই চারজন ছাড়াও বাংলাদেশে এখন বহু নারীকে নিয়েই আলোচনা করা যায়। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, হত্যা, অপহরণের প্রধান শিকার নারী এবং শিশু। আজ আমি সেদিকে যেতে চাই না। বাংলাদেশের শিশু, কিশোর, যুবা, বৃদ্ধ সবাই এখন এই চারজন নারীকে চেনেন। শুধু দেশে নয়, দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিশ্ব দরবারেও তারা সু-পরিচিত। নুসরাত সুন্দরী, মেধাবী, পর্দানশীল একজন নারী। মাদ্রাসার আলিম শ্রেণীর ছাত্রী ছিলেন। অধ্যক্ষের অনৈতিক প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ার জন্য মাদ্রাসা চত্বরে তার শরীরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ১১/১২ দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে মৃত্যুকে বরণ করেন। প্রকাশ্যে এমন ঘটনা ঘটায় ও জনগন সোচ্চার হওয়ায় সরকার নড়েচড়ে বসেন। বিশেষভাবে ঘটনা এখনো আইনের আওতায়। সাথে জড়িত বহু রাঘববোয়াল, ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা, সরকারী কর্মকর্তা, স্বয়ং ওসিও জড়িত। এখনো বিচার সমাপ্ত হয়নি। কতদিন লাগবে তাও জানি না। নুসরাত তুমি মরে বেঁচেছো, তা না হলে হয়ত বিচার প্রক্রিয়ার রাস্তা বদলে যেত। এতদিনে তোমার চরিত্র কতবার হনন করা হত কে জানে? হয়তো বা তোমাকেই কারাবাসে নিক্ষেপ করা হতো। আমি বলবো তুমি সৌভাগ্যবতী, কারণ তুমি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছো। এই সমাজে বহু নারী, গৃহবধূ প্রতিদিন স্বজনদের দেওয়া আগুনে জ্বলে পুড়ে মরছে। ক’টা ঘটনা আমাদের নজরে আসে? এলে আমরা কি এখন “উহ” শব্দটি উচ্চারণ করি? প্রতিজনের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রইল।
মিন্নি ঃ ইতিহাসবীদরা বলে থাকেন পৃথিবীর যত বড় বড় যুদ্ধ, খুন হানাহানি হয়েছে সবই নারীর জন্য। নারীর জন্য ভাল কি হয়েছে সেসব কিন্তু কোনো জ্ঞানী, গুণীজন বলেন না। কারণ নারী এখনো নারী, মানুষ নয়। বাংলাদেশ সহ সারা পৃথিবী টিভি, মিডিয়া এবং ফেসবুকের কল্যাণে দেখেছে প্রকাশ্য রাস্তায় কতিপয় দুর্বৃত্ত রামদা, চাপাতি, লাঠি, বন্দুক নিয়ে শত শত মানুষের সামনে একজনকে কুপিয়ে মারছে এবং এক নারী সেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। মেরেই ফেলল, অবশেষে দুর্বৃত্তগণ স্বদর্পে প্রস্থান করলো। আক্রান্ত ব্যক্তিকে রক্ষা করতে একটি মানুষও এগিয়ে এলো না, কিন্তু মোবাইলে ছবি তুলে ভাইরাল করে দিল। এক দিক দিয়ে ভালই হয়েছে রাষ্ট্রের নজরে এসেছে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে দ্রুত বিচার আইনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সারাদেশ জানে বন্ড এর পেছনে আছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের গড ফাদাররা। তাদের হাতেই তৈরি এইসব বন্ডরা। যে স্ত্রী স্বামীকে বাচাঁতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করলো এখন সবাই জানছে মিন্নি নিজেই এই হত্যাকান্ডের নীল নকশার কারিগরদের একজন। কত ভাবে চরিত্র হনন করা হচ্ছে। রিমান্ডে নিয়ে জবানবন্দী আদায় হয়েছে। গডফাদারদের ভয়ে অসহায় মিন্নির পাশে একজন আইনজীবীও দাঁড়াননি। মিন্নিদের পুরো পরিবারটি অসহায়, নিরাপত্তাহীন ভাবে বেঁচে আছে। মিন্নির প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি না, সে যদি দোষি হয় সঠিক আইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেটা নির্ধারিত হোক। কিন্তু একজন নারীকে নষ্টা, ভ্রষ্ঠা, দ্বিচারিনী প্রমাণ করা বর্তমান সমাজে কত সহজ ভেবে অবাক হই। নুসরাতেরও চরিত্র হনন করতে চেয়েছিলেন ওসি মোয়াজ্জেম।
সর্বত্র নুসরাত, মিন্নির আলোচনার রেশ না কাটতেই আপন মহিমায় জনসম্মুখে আসেন প্রিয়া সাহা। প্রিয়া সাহা এবং তার ঘটনাকেও সামনে আনে ফেসবুক। একেবারেই অন্যরকম ঘটনার সম্মুখীন হয় বাংলাদেশ। এমন ঘটনার নজির বাংলাদেশে ইতিপূর্বে হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। এসবই উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা, ঘটনা। আমি সাধারণ একজন বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে বলতে পারি ভাল লাগেনি। কতিপয় বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া এই দেশে অন্য ধর্মের লোকেরা ভাল আছেন। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলে বোঝা যায় সেসব দেশে কি হচ্ছে? তারপরও যদি কিছু বলার থাকে তবে আমেরিকা কেন? আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে সব ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য যে কোন দায়িত্ব নিতে পিছ পা হবেন না, তা আমরা সকলেই জানি। এমন দেশপ্রেমিক প্রধানমন্ত্রী থাকতে বাইরের মোড়লদের কাছে কেন যাওয়া? প্রিয়া সাহা একজন নারী। জানিনা আগামীতে এ ঘটনা কোনদিকে গড়াবে। তবে আমরা দেশবাসি চাই সঠিক তদন্তের মাধ্যমে আসল সত্য বেরিয়ে আসুক। কোনো ধর্মকে হেয় করা যুক্তিসঙ্গত নয়। বাংলাদেশের ভাবমুর্তি কোথাও লুন্ঠিত হোক এমনটি দেশপ্রেমিক দেশবাসী চাইবেন না। তবে নুসরাত বা মিন্নির মত প্রিয়া সাহার অতীত, বর্তমান নিয়ে টানাহেচড়া হবার সম্ভাবনা কম। আবার হলেও বিস্মিত হবো না। কারণ সেও নারী।
গত দুইদিনের আলোচিত নাম তসলিমা বেগম রেনু। একজন মা, ৪/৫ বছরের “তুবা” নামের মেয়েটির মা। বাবাও সাথে থাকেন না। মা-ই ছিল মেয়েটির সব। সবাই বলে সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সব অসম্ভবের দেশও বাংলাদেশ। সারাদেশে গুজব পদ্ধা সেতুর জন্য “কল্লা চাই”। এক মাদকাসক্তের ব্যাগে শিশুর কাটা মাথা পাওয়া যাওয়ায় গুজব রটনাকারীদের কথা মানুষ সহজে বিশ^াস করতে থাকে। যার সাথে ছেলে ধরার কোন সম্পর্ক নেই। সে ছেলে ধরাও নয়, প্রতিহিংসা বশত সে ওই শিশুকে খুন করেছে। ফেসবুক আর মিডিয়ার কল্যাণে এসব খবর জনমানসে গভীর সারা ফেলেছে। ইতিমধ্যে ২/১ মাসে ১৫/১৬ জনকে পিটিয়ে হতাহত করা হয়েছে। অনেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পিটুনীর জেরে। এত বয়সেও কোনোদিন শুনিনি নির্মাণাধীন কোনো কিছুর জন্য মানুষের কল্লার প্রয়োজন হয়। এ কেমন গুজব? গুজবে কান না দিতে প্রশাসনসহ সকল মহল থেকে প্রচারণা চালানো হলেও ছেলেধরা সন্দেহে মারপিটতো থামছে না। সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা ছেলেধরা মনে করে এক নারীকে বিদ্যালয়ের সামনে সকলে মিলে নির্মমভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। অথচ সেই অভাগিনী মা স্কুলে গিয়েছিলেন তার মেয়েকে স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে আলাপ করতে। কেউ সেই অসহায় নারীর আর্তনাদ শোনেনি। মারা যাওয়ার পরও ১৮/১৯ বছরের একটি ছেলে সেই মৃত মহিলার মাথায় বারবার আঘাত করছিল। কি ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা, নৃশংসতা? পিটিয়ে, কুপিয়ে, গুলি করে, প্রকাশ্যে শত শত মানুষের মাঝে মানুষকে মেরে ফেলা! জানতে ইচ্ছে করে কে মানুষ? যে বা যারা দেখছে তারা? যে মারছে তারা? নাকি যাকে মারছে সে? আমাদের সমাজ, সামাজিক অবক্ষয়তা, নৈতিক মূল্যবোধ, আইন, বিচারের প্রতি ভয়শূন্যতা, নিরাপত্তাহীনতা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? আর এখন নারী-শিশু ধর্ষণ, অপহরণ, হত্যার, মহামারীতে আক্রান্ত। চারজন নারীর কথা উল্লেখ করলাম চারটি কারণ দেখিয়ে। বহু নারী আরও ভয়াবহতার শিকার হয়ে আছেন এই সমাজে। তাদের জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া কিছুই করার নেই আমাদের। বিচারহীনতা সংস্কৃতি অপরাধীদের এ পর্যায় পর্যন্ত এনেছে। অপরাধীদের দ্রুতবিচার আইনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায় দেশবাসি।
জানি না নুসরাতের মা’র চোখের পানি শুকাবে কবে, তখন নুসরাতের দগ্ধ আত্মার শান্তি পাবে। মিন্নি কি স্বামী হত্যার বিচার পাবে? নাকি তাকেই বাকী জীবন কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে কাটাতে হবে ভবিষ্যতই তা জানে। প্রিয়া সাহার বিষয়টি কি হয় তা দেখতে দেশবাসি চেয়ে রইলো। তবে তার পরিবার পরিজন কেমন আছেন জানতে ইচ্ছে করে। তসলিমা, তোমার কাছে আমরা ক্ষমা চাই। তোমার মেয়ে এখনো ভাত খায়নি। তুমি আসলে সে ভাত খাবে। মা মনিকে কে বলবে তার মা যে আর কোন দিন আসবে না।