হবিগঞ্জের রাজনীতিতে নারী নেতৃত্ব

যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন গান গাইবো আর শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলাবাসীর কল্যাণে কাজ করব

এসএম সুরুজ আলী ॥ হবিগঞ্জ সদর উপজেলার শরীফাবাদ গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া মেয়েটির নাম মুক্তা আক্তার। তিনি বাউল শিল্পী হিসেবে সকল মহলে পরিচিত। জন্মের পর পরিবারের দরিদ্রতাকে জয় করতে বাবা সোনাই মিয়ার কাছ থেকে তালিম নিয়ে ৮ বছর বয়সেই তিনি পেশা হিসেবে বাউল গানকে বেছে নেন। বাবা’র সাথে হবিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে মাজারগুলোতে ধর্মীয় গান পরিবেশন শুরু করেন তিনি। পাশাপাশি বিভিন্ন বাউল গানের আসরে গান পরিবেশন করেন। বাউল স¤্রাট শাহ আব্দুল করিম, রাধারমন, দুরবীন শাহসহ দেশের নামীদামী অনেক মরমী গীতি কবিদের গান পরিবেশন করে পরিচিতি লাভ করেন মুক্তা। ১৩ বছর বয়সে তার ‘মাটির বউ’ নামে অ্যালবাম বাজারে বের হয়। প্রথম এ্যালবাম সুপার হিট হয়। এভাবে সিডি, ভিসিডি, অডিও মিলিয়ে প্রায় ৩শ এ্যালবাম বের হয় তার। এ্যালবামগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো- মাটির বউ, কুটুম পাখি, চিরদাসী, প্রাণের মুর্শিদ, মুর্শিদের বাড়ি, প্রাণের কেল্লা, দয়াল গাজী, দয়ার সাগর, চেংরা বন্ধু, কঠিন বন্ধু। ধীরে ধীরে মুক্তা আক্তার বাউল শিল্পী হিসেবে হবিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। বিশেষ করে হবিগঞ্জ জেলায় মহিলা বাউল শিল্পী মানে মুক্তা আক্তার সকলের প্রিয় শিল্পী। যেখানে বাউল গানে তিনি যেতেন সেখানেই মানুষ তার গান শোনার জন্য ভিড় জমাতেন। পরবর্তীতে বাউল গানের পাশাপাশি তিনি আধুনিক গানের তালিম নেন। শুরু করেন আধুনিক গান। বিভিন্ন স্কুল কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে তিনি বাউলের পাশাপাশি আধুনিক গান শুরু করেন। এর মধ্যে ২০০২ সালে তিনি গান পাগল পুরাসুন্দা গ্রামের সুতাং বাজারের ফার্নিচারের ব্যবসায়ী তাহির মিয়াকে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তিনি স্বামী নিয়ে সুরাবই গ্রামে বসবাস করেন। তার স্বামী তাহির মিয়া মুক্তা আক্তারকে বাউল গানের প্রতি আরো উৎসাহিত করেন। বিয়ের পর যেখানেই মুক্তা গানে যেতেন সেখানে স্বামী তাহির মিয়াকে সাথে নিয়ে যেতেন। স্বামীর উৎসাহে সাংস্কৃতিক জগতে তার বিচরণ আরো বেড়ে যায়। গান হয়ে উঠে মুক্তার মুল পেশা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদর্শে বিশ^াসী মুক্তা আক্তার ২০১১ সালে তার স্বামী তাহির মিয়ার অনুপ্রেরণায় নুরপুর ইউনিয়ন যুবলীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা হিসেবে মনোনীত হয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। পরবর্তীতে ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে দলের কোন কর্মসূচি থাকলেই তিনি অংশগ্রহন করতেন। নেতাকর্মীরা সভায় তার কন্ঠে গান গাওয়ার অনুরোধ করলে তিনি গান পরিবেশন করেন। ২০১১ সালে নুপুরপুর ও ব্রাহ্মণডোরা ইউনিয়ন নিয়ে যখন গঠিত ছিল নুরপুর ইউনিয়ন সে সময় ইউনিয়নের ৪, ৫ ও ৬ নং সংরক্ষিত ওয়ার্ড মহিলা মেম্বার নির্বাচিত হন মুক্তা। মহিলা মেম্বার নির্বাচিত হওয়ার পর দলীয় কর্মকান্ডে আরো সক্রিয় হয়ে উঠার পাশাপাশি কোথাও গানের আমন্ত্রণ পেলে সেখানে ছুটে যান মুক্তা। তার গানে মুগ্ধ হয়ে উপহার হিসেবে অনেকেই হাজার হাজার টাকা দিয়েছেন।
২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমপি অ্যাডভোকেট আবু জাহিরের পক্ষে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে জনসংযোগ ও ভোট চেয়েছেন তিনি। আবু জাহির এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর নুরপুর ইউনিয়নকে ভেঙ্গে নুরপুর ও ব্রাহ্মণডোরা ইউনিয়ন গঠন করা হয়। এ সময় মুক্তা যে ওয়ার্ডের মেম্বার ছিলেন সে ওয়ার্ডকে ৭, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ড হিসেবে গঠন করা হয়। বিগত ইউপি নির্বাচনে ৭, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডে আবারও মেম্বার পদে নির্বাচন করেন। নির্বাচনে তিনি ৬১ ভোটে হেরে যান। মেম্বার ইলেকশনে হেরে গিয়ে আবারও জনগণের কাছে থাকার স্বপ্ন দেখেন তিনি। পরবর্তীতে তার স্বামীকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন নবগঠিত শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করার। মহিলা মেম্বার নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার গ্লানি দূর হতে না হতেই তার নিজ এলাকার লোকজন ও গানের ভক্তদের পরামর্শ নিয়ে শুরু করেন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনের গণসংযোগ। গণসংযোগে তার স্বামীসহ শ^শুরবাড়ির অন্যান্য আত্মীয় স্বজন ভক্তরা প্রথম দিকে সাথে থাকতেন। গণসংযোগের শুরুর দিক থেকেই তিনি ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন। তার যখন নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় কাছে চলে আসে তখন অনেকেই মুক্তা আক্তারকে নির্বাচন থেকে সড়ে আসার পরামর্শ দেন। তারা মন্তব্য করেন একটা উপজেলা পরিষদের এলাকা অনেক বড়। এটা কোন মেম্বার নির্বাচন নয়। এ নির্বাচনে ব্যয় বহন করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। এছাড়াও শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভার মেয়রের স্ত্রী পৌর মহিলা লীগের সভানেত্রী সাবেরা সুলতানা হ্যাপীসহ আরো শক্তিশালী প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেবে। এ হিসেবে মুক্তার নির্বাচনে অংশ না নেয়াই ভাল। এ সময় মুক্তা আক্তারের স্বামী তাহির মিয়া নির্বাচনে পরাজয় মাথায় রেখে নির্বাচন করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীতে মনোনয়নপত্র দাখিল শেষে যাচাই-বাছাই করে যখন বৈধ প্রার্থী হয়ে পদ্মফুল প্রতিক নিয়ে নির্বাচনের মাঠে প্রচারণায় নামেন তখন তিনি জনগণের ব্যাপক সাড়া পান। বিশেষ করে শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার প্রত্যেকটি গ্রামেই তার গানের ভক্তরা তার জন্য নিজ নিজ উদ্যোগে কাজ শুরু করেন। যখন মুক্তা আক্তার উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে প্রচারণায় যান তখন মহিলারা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং ভোট দেয়ার আশ^াস দেন। কিন্তু জনগণের এতো সাড়া পাওয়ার পরও মুক্তার মনে পরাজয়ের ভয় তাড়া করে। চারদিকে লোকজন বলাবলি শুরু করেন সাবেরা সুলতানা হ্যাপি আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সাথে নির্বাচন করে জয়লাভ করা কঠিন। তারপরও মুক্তা আক্তার মনোবল শক্ত করে বিজয়ের আশা নিয়ে নির্বাচনের লড়াই মাঠে থাকেন।
সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১৮ জুন অনুষ্ঠিত শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বাউল শিল্পী মুক্তা আক্তার ৮ হাজর ২০২ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি সাবেরা সুলতানা হ্যাপি (কলম) পান ৭ হাজার ৬৯২ ভোট। অপর প্রার্থী মমতাজ বেগম ডলি (প্রজাপতি) ৫ হাজার ৬৯৩ ভোট, রুবিনা আক্তার (ফুটবল) ৫ হাজার ২২ ভোট ও পারভিন আক্তার (হাঁস) ১ হাজার ২০৩ ভোট পান। ৫১০ ভোট বেশি পেয়ে মুক্তা আক্তার নির্বাচিত হন।
এ ব্যাপারে মুক্তা আক্তার জানান, দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়ে অনেক কষ্টে বড় হয়েছি। যে কারণে বেশি লেখাপড়া করতে পারেনি। বাবা গানের মানুষ হওয়ায় আমাকে গানের জগতে নিয়ে যান। এই সাংস্কৃতিক জীবন আজ আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। এছাড়া গান রক্তের সাথে মিশে গেছে। অতএব গান ছাড়তে কষ্ট হবে। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন গান গাইবোই। তিনি বলেন- নির্বাচনে আমার নিজ ইউনিয়ন নুরপুরবাসীসহ ব্রাহ্মণডোরা ইউনিয়ন, শায়েস্তাগঞ্জ ইউনিয়ন, শায়েস্তাগঞ্জ পৌরসভার সাধারণ ভোটারসহ আমার গানের ভক্তরা নিজের খেয়ে আমাকে নির্বাচিত করার জন্য কাজ করেছেন। এ জন্য আমি সকলের প্রতি কতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। নবগঠিত শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার প্রথম মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে আমার কাজই হবে উপজেলাবাসীর উন্নয়ন। এমপি অ্যাডভোকেট মোঃ আবু জাহির, উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ তালুকদার ইকবাল, ভাইস চেয়ারম্যান গাজিউর রহমান ইমরানের সাথে সমন্বয় রেখে আমি এলাকার উন্নয়নে কাজ করতে চাই। এ জন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করি। তিনি বলেন- আমাকে এখানে নিয়ে আসার সবচেয়ে বড় অবদান স্বামী তাহির মিয়ার। এজন্য স্বামীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন মুক্তা আক্তার। পাশাপাশি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শায়েস্তাগঞ্জবাসীর সেবা করে যাওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন তিনি।
নবনির্বাচিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মুক্তা আক্তার বলেন- নারীরা রাজনীতিতে আসলে তাদের যেন পরিবার থেকে বাঁধা না দেয়া হয়। নারীদের রাজনীতিতে এগিয়ে আসলে দেশের উন্নয়ন ও মঙ্গল হবে। জননেত্রী শেখ হাসিনা নারীদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। নারীদের রাজনীতিতে সব সময় উৎসাহ দিয়ে আসছেন প্রধানমন্ত্রী। তা না হলে নারীরা রাজনীতিতে আসতেন না। আমিও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনে অংশগ্রহন করতে পারতাম না। তাই আমি আহ্বান জানাবো, নারীরা যেন রাজনীতিসহ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও এগিয়ে আসেন।
প্রসঙ্গত, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মুক্তা আক্তার ব্যক্তিগত জীবনে ১ সন্তানের জননী। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী মহিলা লীগ নুরপুর ইউনিয়ন শাখা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও জেলা বাউল শিল্পী কল্যাণ ফেডারেশনের মহিলা বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি সুতাং থিয়েটারের একজন নিয়মিত সদস্য।