এসএম সুরুজ আলী ॥ আজমিরীগঞ্জের পশ্চিমবাগ গ্রামের রীমা রানী দেব ও রুনা রানী দেব একই মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণকারী জমজ দুই বোন। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে না পারায় তাদের বাবা দূর্গাচরণ দেব মারা গেছেন ৭ বছর পূর্বে। এ অবস্থায় তাদের মা বাসন্তী রানী দেব জমজ দুই কন্যাসহ ৫ সন্তান নিয়ে চরম বিপাকে পড়ে যান। বাবা মারা যাওয়ার পর প্রথম অবস্থায় তাদের ছোট চাচা কিছুদিন রীমাদের দেখাশোনা করলেও হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনিও। এ অবস্থায় রীমা ও রুনার মা সন্তানদের লেখাপড়া করানো নিয়ে আরো বিপাকে পড়েন। নিয়তির নির্মম পরিহাসে বাধ্য হয়ে তিনি মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঝি এর কাজ শুরু করেন। এ কাজ করে যে অর্থ উপার্জন হয় তা দিয়ে সংসার চালানোই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সন্তানদের পড়াশোনা করানো তো দু:স্বপ্ন। এক পর্যায়ে বাসন্তী রানী বড় মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ করে দেন। তারপর বড় মেয়ে তার সাথে মানুষের বাড়িতে কাজ শুরু করেন। মা-মেয়ে কাজ করে সংসার চালান এবং রীমা ও রুনার লেখাপড়া খরচ বহন করেন। তবে লেখাপড়ার পুরো খরচ পরিবার থেকে দিতে হয়নি। তাদের মেধা ও সংসারের করুণ অবস্থা দেখে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের বেতন মওকুফ করে দেন। এর মধ্যে রীমা ও রুনা রানী’র বড় বোনের বিয়ের আলাপ আসে। হিন্দু বিয়েতে সাধারণত বরপক্ষকে অনেক অর্থের যোগান দিতে হয়। মেয়ের বিয়ে দেয়া নিয়ে বাসন্তী রানী পড়েন বিপাকে। এক পর্যায়ে বাসন্তী রানী বড় মেয়ের বিয়ে ঠিক হলো। বিয়ের খরচ কিভাবে জোগার করবেন। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন তিনি। শেষ পর্যন্ত আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসীর সহযোগিতা নিয়ে মেয়েকে বিয়ে দেন। সংসারের অভাব অনটন ও মায়ের সাথে অন্যের বাড়িতে কাজ করে এসএসসি পাশ করেন রীমা ও রুনা রানী দেব। তারা এসএসসি পাশ করার পর পরই তাদের মা বাসন্তী রানী অসুস্থ পড়েন। নিয়মিত তাকে ঔষুধ খেতে হয়। প্রতিদিন গড়ে বাসন্তী রানীর ৫০ টাকার ঔষধ লাগে, কিন্তু এ টাকা কোথা থেকে আসবে এ নিয়ে দু:চিন্তার মধ্যে পড়েন রীমা ও রুনা। মাকে বাঁচাতে গিয়ে তারা দু’জন চাকুরী করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু চাকুরী কোথায় পাবেন। আর চাকুরী তো সোনার হরিণ। টাকা লাগে এতো টাকা তারা কোথায় পাবে। এসব চিন্তার মধ্যে পত্রিকার মাধ্যমে পুলিশ ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল পদে নিয়োগের সংবাদ জানতে পারেন রীমা ও রুনা। তারপর ২শ’ টাকা খরচ করে দুই বোন আবেদন করেন। প্রথমে তারা যাচাই-বাছাইয়ে ঠিকে যান। লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ভাল ফলাফল অর্জন করে পাশ করেন দু’বোন। গতকাল রবিবার চুড়ান্ত প্রার্থী হয়ে দু’বোন হবিগঞ্জ পুলিশ লাইনে আসার ডাক পান। এদিকে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা বিপিএম পিপিএম-সেবা প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করেন। প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের সামনে উপস্থিত করান রীমা, রুনা ও তাদের মা বাসন্তী রানীকে। তারা সাংবাদিকদের সামনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিজেদের ভাগ্য বিড়ম্বনার এসব চিত্র তুলে ধরেন। তাদের এই করুণ অবস্থার কথা শোনে পুলিশ সুপারসহ উপস্থিত সাংবাদিকবৃন্দ আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। রীমা, রুনা ও তাদের মা বাসন্তী রানী বলেন- একেবারে স্বচ্ছতার সাথে চাকুরী হয়েছে। সেক্ষেত্রে তাদের কোন তদবির করতে হয়নি। এ জন্য তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, পুলিশ সুপারসহ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যারা ছিলেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। দেশসেবায় কাজ করার জন্য সকলের সহযোগিতা ও আশির্বাদ কামনা করেন নিয়োগ পাওয়া দুই বোন।
প্রেস ব্রিফিংকালে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হবিগঞ্জ সদর সার্কেল) মোঃ রবিউল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বানিয়াচং সার্কেল) শৈলেন চাকমা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার লুৎফুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাজু আহমেদসহ পুলিশের অন্যান্য কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, হবিগঞ্জ জেলা থেকে প্রাথমিকভাবে নারী পুরুষ ৯৭ জনকে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল হিসেবে মনোনীত করা হয়। এর আগে ১ জুলাই ৩ হাজার ৬৩৪ জন প্রার্থীর মধ্যে স্লীপ বিতরণ করা হয়। তন্মধ্যে ১ হাজার ৯৯ জন প্রার্থী শারীরিকভাবে বাছাই পর্বে উত্তীর্ণ হন। ২ জুলাই ১ হাজার ৯৯ জন লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। ৩ জুলাই লিখিত পরীক্ষায় অংশ গ্রহনকারী ২১৬ জন কৃতকার্য হয়। এর মধ্যে পুরুষ ১৬৪ ও মহিলা ৫২ জন। ৪ জুলাই ২১৬ প্রার্থীর মনস্তাত্ত্বিক ও মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। ২১৬ জন প্রার্থীর মধ্যে সাধারণ কোটা পুরুষ ২০জন, মুক্তিযোদ্ধা পুরুষ ২০ জন, অন্যান্য কোটায় ৯ জন এবং সাধারণ কোটায় নারী ৩৪ জন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নারী ৪ জন এবং অন্যান্য কোটায় আরো একজন প্রার্থীকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা হয়।