স্টাফ রিপোর্টার ॥ হবিগঞ্জ শহরের চৌধুরী বাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ রুকন উদ্দিনের কন্যা, ঢাকা স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী রুবাইয়াত শারমিন রুম্পার (২৫) লাশ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের জিম্মায় হস্তান্তর করেছে রমনা থানা পুলিশ। সে ওই এলাকার শান্তিবাগে তার মা’য়ের সাথে ভাড়া বাসায় থেকে পড়াশুনা করতো। তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। রুম্পাকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে ক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস।
সূত্র জানায়, বুধবার রাতে ঢাকার রমনা থানাধীন ৬৪/৪ নম্বর সিদ্ধেশ্বরীর সার্কুলার রোডের গলি থেকে রুম্পার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে পুলিশ লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়, তরুণীর মেরুদন্ড, বাঁ হাতের কনুই ও ডান পায়ের গোড়ালি ভাঙা। মাথা, নাক, মুখে জখম এবং রক্তাক্ত অবস্থায় ছিল। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে তাকে ধর্ষণ করে হত্যার আলামত পাওয়া গেছে। প্রথমে রুম্পার লাশ অজ্ঞাত হিসাবে উদ্ধার হওয়ায় রমনা থানার এসআই আবুল খায়ের বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়েছে।
মামলা তদন্তের প্রধান সমন্বয়কারী পুলিশের রমনা জোনের এসি এসএম শামীম জানান, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্রী রুম্পাকে হত্যা করা হয়েছে এ বিষয়ে তারা নিশ্চিত। থানা পুলিশসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা খুনীদের চিহ্নিত ও আইনের আওতায় আনার জন্য মাঠে কাজ করছে।
গতকাল দুপুরে ৬৪/৪ নম্বর সিদ্ধেশ্বরীর সার্কুলার রোডের গলিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ৩টি ভবন রয়েছে। একটি বামে, একটি সোজা এবং একটি ডানে। সবগুলোর করিডোর আটকানো। শুধু আয়েশা শপিং কমপ্লেক্সের সপ্তমতলা এবং দশম তলার করিডোর দিয়ে কাউকে ফেলা যেতে পারে বলে পুলিশের ধারণা। অথবা বাকি দুই বাসার ছাদ থেকে তাকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। ওই তিন ভবনে একাধিক ছেলে ও মেয়েদের মেস রয়েছে। তারা অধিকাংশই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া। দুই বাসার পেছনে ও আয়শা শপিং কমপ্লেক্সের মধ্যেখানে তার লাশ পড়ে ছিল। ঘটনাস্থলের বাসার কেয়ারটেকার সুমন জানান, ওপর থেকে কে বা কারা তাকে যখন ফেলে দেয় তখন আমরা শব্দ পেয়েছি। কাছে গিয়ে দেখি একজন তরুণীর রক্তাক্ত দেহ। অনেকজন সেখানে জড়ো হলে তাকে কেউ চিনতে পারেনি। পরে পুলিশকে খবর দিলে তার লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যায়। তবে আরেকজন কেয়ারটেকার জানান, ওই তরুণীকে তিনি সিদ্বেশ্বরী এলাকায় কয়েকবার দেখেছেন। এছাড়াও একজন তরুণের সঙ্গে রিকশায় করে আয়শা কমপ্লেক্সের সামনে একদিন নামতে দেখেছেন। রুম্পার সহপাঠিরা জানায়, আলখাছ আহমেদ সৈকত নামে এক ছাত্রের সাথে খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। হয়তবা সে এ ঘটনার সাথে জড়িত থাকতে পারে। তবে রমনা থানার ওসি জানান, হত্যাকারী যে-ই-হোক তাকে ছাড় দেয়া হবে না। কোন তথ্য পাওয়া মাত্রই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মামলার তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রমনা থানার এক কর্মকর্তা জানান, ঘটনাটি শুরু থেকেই রহস্যেঘেরা। পুলিশ শুরুতে ওই তরুণীর লাশ অজ্ঞাত হিসাবে উদ্ধার করে। পরে পুলিশ নিশ্চিত হয় সে হবিগঞ্জ শহরের চৌধুরী বাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ রুকন উদ্দিনের কন্যা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রুম্পার স্বজনরা মর্গে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন। রাজধানীর শান্তিবাগে মা ও ভাইয়ের সঙ্গে থাকতেন রুম্পা।
সূত্র জানায়, মর্গে রুম্পার লাশের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর গোয়েন্দারা খুনীদের চিহ্নিত করার জন্য মাঠে নেমেছে। গতকাল সকালে সিদ্ধেশ্বরীর স্ট্যামফোর্ড ইউনিভারসিটির ক্যাম্পাসে গিয়ে রুম্পার যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করেছে ঢাকা মহানগর পূর্বের গোয়েন্দা পুলিশ ও রমনা থানা পুলিশের একটি দল। রুম্পা বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তার মোবাইল ফোনটিও রেখে গিয়েছিলেন। ওই মোবাইল ফোনটি জব্দ করেছে তদন্তকারীরা।
সূত্র জানায়, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর সেখানে ‘স্ট্রে বার্ড’ নামে একটি কালচারাল সংগঠনের সদস্য হন রুম্পা। রুম্পা ছিলেন ভাল অভিনেত্রী। হাঁসি ও খুশিতে সর্বক্ষণ সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন তিনি। তার হত্যাকান্ডে অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছেন নিহতের সহপাঠীরা। নিহতের এক সহপাঠী জানান, রুম্পার সঙ্গে এক ছেলের সম্পর্ক ছিল। ওই সম্পর্ক কিছুদিন ধরে টানাপড়েনের মধ্যে ছিল। এতে সে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল।
সূত্র জানায়, ওই বয়ফ্রেন্ড অন্য এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়েছিলো। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক শেখ নাহিদ নিয়াজ জানান,‘রুম্পা খুব ভাল মেয়ে ছিল। সে কোন ক্লাস মিস দিতো না। সর্বক্ষণ হাসিখুশি থাকতো। তার এ ঘটনা শুনে আমরা ব্যথিত হয়েছি। এ ঘটনার যারা দোষি তারা কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হোক এটাই আমাদের চাওয়া।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন থাকাকালিন সময়ে রুম্পা কোন সহপাঠির সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে ছিল কি না এ নিয়ে সন্দেহের বাসা বেঁধেছে তার পরিবারের লোকদের মাঝে। নিহত রুম্পার চাচা জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে তার পরিবারের কোন ধারণা নেই। হয়তবা থাকতেও পারে। নিহত রুম্পার চাচা আরও জানান, সে টিউশনি শেষ করে বাসায় এসে টাকা-পয়সা, মোবাইল সব রেখেই বের হয়েছে। পায়ে হিল ছিল সেটাও খুলে স্লিপার সো পরেই বের হয়েছিল বলে শুনেছি।
রুম্পার স্বজনরা জানান, দুই ভাইবোনের মধ্যে রুম্পা ছিলেন বড়। তাদের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে। রুম্পা শাহজাহানপুরের শান্তিবাগের ২৫৫ নম্বর বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে মা-ভাইয়ের সঙ্গে থাকতেন। বাসা থেকে ৪-৫ মিনিট দূরত্বের একটি ফ্ল্যাটে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতেন তিনি। প্রতিদিনের মতো বুধবার বিকেলে বাসা থেকে বেরিয়ে প্রাইভেট পড়াতে যান। এক ঘণ্টা পড়ানোর পর বের হয়ে বাসার নিচে গিয়ে রুম্পা তার মাকে ফোনে বলেন, চাচাতো ভাইকে দিয়ে বাসার নিচে তার একজোড়া স্যান্ডেল পাঠাতে। ১০ বছরের চাচাতো ভাই একজোড়া স্যান্ডেল নিয়ে নিচে নামে। ওই স্যান্ডেল পরিবর্তন করে পায়ে দেন রুম্পা। এরপর তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন, আংটি, হাতঘড়ি ও ব্যাগ চাচাতো ভাইয়ের কাছে দেন। তাকে বলেন, আম্মুকে বলিস আপু একটু পরে বাসায় ফিরবে। রুম্পা সেখান থেকে চলে যান। মোবাইল ফোন, আংটি, হাতঘড়ি ও ব্যাগ বাসায় পাঠোনোর উদ্দেশ্য কী ছিল তা বলতে পারছেন না স্বজনরা। রাতে বাসায় না ফেরায় খোঁজাখুঁজি শুরু হয়।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আরিফুর রহমান জানান, ঘটনার পর পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে রুম্পার সকল নথি নিয়ে গেছেন। আমরা তদন্তে পুলিশকে সকল সহযোগিতা করবো। পারিবারিক সূত্র জানায়, লাশের ময়নাতদন্ত শেষে নিহতের পরিবারের সদস্যরা তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বিজয়নগরে নিয়ে যান। এসময় রুম্পার স্বজনরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সেখানে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্রী রুবাইয়াত শারমিন রুম্পাকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে ক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস। হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবিতে শুক্রবার স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস ও এর আশপাশ এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। সিদ্ধেশ্বরী ক্যাম্পাসে ওই বিক্ষোভ করা হয়। বিক্ষোভ থেকে শনিবার ফের কর্মসূচি ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা। সেখানে সিদ্ধেশ্বরী ও ধানমন্ডি ক্যাম্পাসে একযোগে কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
একটি সূত্র জানায়, রুম্পার লাশ উদ্ধারের ঘটনায় বয়ফ্রেন্ডের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। রুম্পার সঙ্গে সৈকতের ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। বেশ কিছুদিন ধরে তাদের সম্পর্কের অবনতি হয়। বিয়ের জন্য চাপ দেয়ায় রুম্পাকে এড়িয়ে চলছিলেন সৈকত। বয়ফ্রেন্ডের প্রতারণার বিষয়টি মেনে নিতে পারছিলেন না রুম্পা। ওই ঘটনার বিষয়ে বয়ফ্রেন্ডের কোন সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তা নিশ্চিত হতে তাকে খোঁজা হচ্ছে। তাকে আটক করতে পারলে ঘটনার মোটিভ উদঘাটন করা সম্ভব হবে বলে ধারণা করছে পুলিশ।
প্রাথমিকভাবে এক বয়ফ্রেন্ডকে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে ওই বয়ফ্রেন্ড। যে বাসা থেকে মেয়েটিকে নিচে ফেলা হয়েছে ওই বাসাটিও চিহ্নিত করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com