সে যে আমার জন্মভূমি (নয়)
ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব
সৎ নিঃস্বার্থ ভালবাসার মানুষজন ও মহীয়সী ব্যক্তিবর্গ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছেন
দেশপ্রেম, সততা এবং আইনের শাসনের কথা বলছিলাম। দেশপ্রেম থাকলে দেশের জনগণকে অবশ্যই ভালবাসতে হবে, জনগণের বন্ধু হতে হবে। মহাত্মা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, শেরে বাংলা এ কে এম ফজলুল হক, বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখার্জি, নেতাজী সুভাস বসু এমনি এমনি এসব উপাধি লাভ করেননি। এমনিতেই এই মহাপুরুষদের নামের পূর্বে এসকল সম্মানজনক টাইটেল সংযুক্ত হয়নি। ইতিহাসের পাতায় উপাধিগুলো স্বর্ণাক্ষরে খচিত আছে এবং থাকবেও। এসকল অকুতোভয় নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তিগত তাদের জীবন, প্রাণ, মেধা সবকিছু দেশের তরে অকাতরে সম্প্রদান করে গেছেন। উনাদের দেশপ্রেমের মাত্রা পরিমাপ করার কোন মাপকাঠি ছিল না। এমনিতর শত শত দেশপ্রেমিক বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনেও জীবন দান করে গেছেন। দিল্লি গেইটে ছয় হাজার মুসলিম শহীদের নাম সহ প্রায় নয় হাজার দেশপ্রেমিকের নাম খোদাই করে লিখা আছে। আমরা আজো শ্রদ্ধার সাথে এ বীর দেশপ্রেমিকদের স্মরণ করি।
আজ কেন জানি মনে হচ্ছে মানুষকে ভালবাসার সেই সৎ, নিঃস্বার্থ ভালবাসার মানুষজন, ভালবাসার মহান ও মহীয়সী ব্যক্তিবর্গ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছেন। রাজার নীতিতে অটল রাজনীতিবীদগণ আজ আর তেমনটা নেই। অতীব নগন্য বা হাতে গোনা স্বল্প সংখ্যক থাকলেও বেশিরভাগই সন্ত্রাস এবং পেশীশক্তির নিকট অনেকটাই পরাস্ত এবং কেউ কেউ নিজেরাই এর মূল হোতা। আজ যারা যতটা নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত, সতত চাটুকার তোষামোদকারী কর্তৃক পরিবেষ্টিত তারাই তত ক্ষমতাবান।
হ্যা, ব্রিটিশদের মতোই তারা devide & rule বা বিভাজন তত্ব প্রয়োগ করে শাসন ও শোষণ চালিয়ে যাচ্ছেন নির্বিকার চিত্তে। স্বাধীনতার সময়ে প্রায় শতভাগ ঐকবদ্ধ একটা জাতিকে বিভিন্ন অজুহাতের দোহাই তোলে খন্ড খন্ড করে বিবাদে জড়িয়ে ফায়দা লুটছেন তথাকথিত রাজনৈতিক দেশপ্রেমিকগণ। কতিপয় চাটুকারদের বিভিন্ন কাজের কন্ট্রাক্ট, টেন্ডারবাজি, বালু মহাল ও জলমহাল, দালালি, বাজার ইজারাদারি সবকিছুতেই সুযোগ প্রদান করে নিজেরাও নিজেদের হিস্যা আদায় করে নিচ্ছেন কড়ায় গন্ডায়।
মজার ব্যাপার হলো হিসেবে বা হিস্যায় গড়মিল হলে বা না পোষালে চাটুকার বা তোষামোদকারীকে এসকল নেতৃবৃন্দ হেনস্তা অথবা গলা ধাক্কা দিয়ে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে একটুও সংকোচবোধ করেন না, তেমনি নেতাগণও যদি কোনরূপ বেকায়দায় পড়ে যান তখন একসময়কার প্রাণপ্রিয় এসব নেতাদেরকেও চাটুকারেরা ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলতে কার্পণ্য করে না বিন্দুমাত্র। যেমন করে নিজের মূল্যবান জিনিসটার প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে মানুষ অনায়াসে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
কি বিচিত্র খেলা রাজার নীতির এই রঙ্গমঞ্চে! দেশপ্রেম না থাকলে দেশের সম্পদ এবং জনগণের প্রতি ভালবাসা থাকবে তার কোনই কারণ নেই। দেশকে এগিয়ে নেয়ার বিপরীতে বরং শোষণ করে এবং জনগণকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার মানিসকতায় প্রকটভাবে মত্ত হয়ে পড়েন এসকল নেতাগণ। ক্রমশ বর্ধ্বমান লোভ লালসা, চাঁদাবাজি, কমিশন ও নিয়োগ বাণিজ্য, বিভিন্ন প্রকল্প আত্মসাত যেন আজ নিত্তনৈমিত্তিক ব্যপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা ওপেন সিক্রেট।
যদিও মার্ক টোয়াইন এর মতে ‘Politicians are like diapers. They need to be changed regularly and for the same reason.’ অর্থাৎ ‘রাজনীতিবিদগণ হলেন ন্যাপির মত। এসব নিয়মিতভাবেই পরিবর্তন করা দরকার এবং একই কারণে।’ আমি দার্শনিকের এ উক্তির সাথে সম্পূর্ণ একমত না হলেও ব্যক্তিগত ও চাকুরীকালীন অভিজ্ঞতার কারণে নব্বই ভাগ সহমত পোষণ করি।
অনেক দার্শনিক বলে থাকেন, দুই ধরণের লোক মিথ্যা বলবেই। ‘এক হল রাজনীতিবিদ, দুই হলো পুরোনো গাড়ি বিক্রেতা।’ সর্বক্ষেত্রে সঠিক না হলেও কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়।
আজকালকার নেতৃবৃন্দ কেনিয়ান মোয়াই কিবাকীর একথা ভুলেই গেছেন যে ‘নেতৃত্ব মানে অন্যদের জীবনকে সুন্দর করার সুবর্ণ সুযোগ। এটা নিজের লালসা পূর্ণ করার সুযোগ নয়।’
আমদের এখন দারিদ্র্য এবং দুর্নীতি থেকে উত্তরণের জন্য সততা এবং আইনের শাসনের সঠিক প্রয়োগের আর কোন বিকল্প নেই। তা দুর্নীতি সম্পৃক্ত নেতৃবৃন্দ, চাটুকার এবং সাধারণ জনগণ সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এখন উপযুক্ত সময় হলো কথা কম, কাজ বেশি করার। অথচ নিক ফিউয়িংসের মতে এখন যা সঠিক তা হলো ‘বেশিরভাগ সময়েই সবচেয়ে জোরালো গলার লোকটি বাজে নেতা হয়; নিজের নেতৃত্ব ঢাকতেই সে চড়া গলায় কথা বলে।’
তাই আবারো বলছিলাম, দেশটা আমার, আমাদের, আমরা সতেরো কোটি জনগণের। দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত ও দুর্নীতিমুত করার নৈতিক দায়িত্বও আমাদেরই।
কারণ সে যে আমার জন্মভূমি ॥