শুরু থেকেই জাতীয় দিবস উদযাপনের পাশাপাশি বই উৎসব বসন্ত বরণ নবীণ বরণ শিক্ষা সফর চড়–ইভাতি অনুষ্ঠান করছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি

মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ ‘আনন্দময় শৈশবে হোক আনন্দময় শিক্ষা’ এই প্রত্যয়ে ১৯৯৮ সালে হবিগঞ্জ শহরের বাণিজ্যিক এলাকায় ‘মাতৃছায়া শিশু কানন’ নামে শুরু হয় মাতৃছায়া স্কুলের পথচলা। এর প্রতিষ্ঠাতা হবিগঞ্জের প্রথম কিন্ডারগার্টেন স্কুল ‘দি রোজেস শিশু কিশোর বিদ্যালয়’ এর প্রথম ব্যাচের ছাত্র বন্ধু মঙ্গল রায়। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে হাঁটি হাঁটি পা পা করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি আজ সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ‘মাতৃছায়া কেজি এন্ড হাই স্কুল’ নামে পরিচালিত হচ্ছে।
মাতৃছায়া কেজি এন্ড হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক বন্ধু মঙ্গল রায় বলেন, ১৯৯৮ সালে শহরের বাণিজ্যিক এলাকায় ‘মাতৃছায়া শিশু কানন’ নামে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠা করি। শিশু ও নার্সারী বিভাগ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। ৫৪ জন ছাত্রছাত্রী দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হলেও দিন দিন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে ‘মাতৃছায়া কেজি এন্ড হাই স্কুল’ নামে হাই স্কুল শাখায় উন্নীত করা হয়। শুরু থেকেই শিশুর আনন্দময় শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠানটি অভিভাবকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে।
তিনি বলেন, আধুনিককালে শিক্ষা নিয়ে যত গবেষণা চলছে, যত আয়োজন চলছে প্রায় সবই হচ্ছে শিশুকে নিয়ে। আগে যে শিক্ষা পদ্ধতি ছিল বর্তমানে তার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানকালে শিশুর শিক্ষার ক্ষেত্রে তার বয়স, মেধা, সামর্থ্য, মানসিক পরিপক্কতা ইত্যাদি বিবেচনা করে পাঠ্য তালিকা প্রণয়ন করা হয়। আধুনিক কিন্ডারগার্টেনের জনক ফ্রয়েবেল রুশোর মতে ‘শিশুকে কিছু শেখাতে হলে তাকে আগে ভাল করে জানতে হবে। একজন শিক্ষক শিশুকে কোন কিছু শেখাতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন তার প্রকৃতির সাথে পরিচিত হওয়া এবং সে অনুযায়ী শিক্ষাদান করা’। ১৮৩০ সালে তিনি প্রথম ব্লান কেনবার্গের একটি শহরে ৩ থেকে ৮ বছর বয়সী শিশুদের নিয়ে একটি নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম দেন ‘কিন্ডারগার্টেন’। তিনি কিন্ডারগার্টেনকে বাগান, শিক্ষককে মালি এবং শিশুকে চারা গাছের সাথে তুলনা করেছেন। আমাদের দেশে অধিকাংশ বিদ্যালয়ে যে গতানুগতিক শিক্ষা পদ্ধতি তা মোটেও আনন্দদায়ক ও শিশুকেন্দ্রিক শিখনের উপযোগীর জন্য যথেষ্ট নয়। প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধা বিকাশের সময়। এ সময় শিক্ষার্থীরা যথাযথ দিক নির্দেশনা পেলে নিজের মেধাকে সঠিকভাবে বিকশিত করতে পারে। শুধু পড়ে এবং মুখস্থ পড়ার উপর নির্ভর করে ভাল ছাত্রছাত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় না। শিক্ষককে মুখস্থ নির্ভর বিদ্যার বাইরে শুনা, বলা, পড়া এবং লেখার দক্ষতা অর্জনে শ্রেণিকক্ষে শিখন কৌশল ব্যবহার করে শিক্ষার্থীকে বাস্তবধর্মী কার্যকর দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, মাতৃছায়া কেজি এন্ড হাই স্কুলে শিক্ষার্থীর মেধা ও সামর্থ্য বিবেচনা করে শিশু মনোবিজ্ঞান এবং আধুনিক শিক্ষার উন্নয়ন পদ্ধতি অনুযায়ী পরিকল্পিত পাঠদান ব্যবস্থা, শিক্ষা-শিক্ষক এবং স্কুলের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। শিক্ষার্থীদের মেধা মূল্যায়নের জন্য নির্ধারিত পরীক্ষার বাইরে শ্রেণি উপযোগী বাস্তবমুখি আইকিউ ভিত্তিক পরীক্ষা গ্রহণ, কম্পিউটার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আধুনিক চিন্তার প্রতিফলন, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও পর্যাপ্ত অনুশীলনের মাধ্যমে দুর্বল ছাত্রদের আলাদা করে যতœ নেয়া হয়। শিশুর মানসিক ও বুদ্ধির বিকাশে পাঠ্যপুস্তকের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাস্তব, অর্ধবাস্তব এবং উপকরণ ব্যবহার করে নতুন নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে শিক্ষাদান, বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মেধা পদক ও পুরস্কার প্রদান করা হয়।
এ ছাড়াও বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শিখন-শিক্ষন, ভিজ্যুয়াল এন্ড অডিটরি লার্নিং, শ্রেণিকক্ষে সহজ উপকরণ উপস্থাপন, শিশুর মনোশিক্ষা, শেখার বিভিন্ন উপায়, শিখন সহায়ক গান, খেলা, বয়স ও মেধা অনুসারে পাঠ পরিকল্পনা, শ্রেণি কক্ষে শিশুর সাথে আচরণ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
তিনি বলেন, স্কুলে শিশু শিক্ষার মান উন্নয়নে নিজস্ব ৮টি পাঠ্য বই প্রকাশিত হয়েছে। ‘শিশু কিশোর’ নামে শিশু সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে আসছে নিয়মিত। স্কুলে রয়েছে শিশু শিক্ষার উপর গবেষণামূলক নিজস্ব ও স্বতন্ত্র সিলেবাস এবং শিক্ষা পদ্ধতি।
তিনি মনে করেন, শিশু শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের বিকল্প নেই। প্রাচীনকালে শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকের স্থান ছিল মূখ্য আর শিক্ষার্থীর স্থান ছিল গৌণ। তখন শিক্ষকের ইচ্ছেমতো শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হতো। শিক্ষার্থীর বয়স, মানসিক ক্ষমতা, আগ্রহ প্রবণতা, ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল্য দেয়া হতো না। কিন্তু বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার মূল কেন্দ্র বিন্দু শিক্ষার্থী। তাই শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের বিকল্প নেই। কারণ প্রশিক্ষণে অর্জিত সক্ষমতা শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগের মাধ্যমে শিশুর শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত যোগ্যতা অর্জনে সহায়ক হবে।
মাতৃছায়া কেজি এন্ড হাই স্কুলে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপন, সকলের অংশগ্রহণে বই উৎসব, বসন্ত বরণ, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন, নবীণ বরণ, শিক্ষা সফর, চড়–ইভাতি অনুষ্ঠান পালন করা হয়। তাছাড়া স্কুলের শ্রেণিকক্ষে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা ও নির্ধারিত আসন ব্যবস্থা, স্বল্প সংখ্যক পাঠ্যপুস্তকের ব্যবহার, শিশু শ্রেণি থেকে ১ম শ্রেণি পর্যন্ত অডিও, ভিডিও এবং বাস্তব অর্ধবাস্তব উপকরণ ব্যবহার করে শিক্ষাদান করা হয়। শ্রেণিকক্ষে কোন শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেয়া হয় না। প্রত্যেক শ্রেণিকক্ষে ৩০ জন শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছেন ২ জন প্রশিক্ষক।
সাফল্য : বিদ্যালয়টি ইতোমধ্যে ২৩ বছরে পদার্পন করেছে। এই পথ পরিক্রমায় হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও বিকেজিসি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থী তাদের মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় কৃতিত্ব অর্জন করেছে। যা একটি প্রতিষ্ঠানের গুণগত শিক্ষার ফল। পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় শুরু থেকেই শতভাগ সফলতা অর্জন করে আসছে স্কুলের শিক্ষার্থীরা। তাছাড়া বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অন্যান্য স্কুলের শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সেরা সাফল্য অর্জনের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। এ প্রতিষ্ঠানের ২৭ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন মেডিকেলে অধ্যয়ন করছে। এই স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে তাদের প্রথম পাঠশালা দেখতে এসে আবেগাপ্লুত হয়ে স্কুলে জন্য কিছু করার প্রয়াস ব্যক্ত করে। এছাড়াও এ স্কুলের ৭৩ জন শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। স্কুলের এ সফলতায় স্কুল পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান মোতাহের হোসেন চৌধুরীর অবদানের কথা তিনি কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন স্কুলের পরিচালক বন্ধু মঙ্গল রায়।
স্কুলের সময়সূচি : প্রতি শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে ১১টা এবং সাড়ে ১১টা থেকে বেলা ২টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত ২ শিফটের মাধ্যমে একাডেমিক পাঠ নেয়া হয়। প্রতি শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে সাংস্কৃতিক বিভাগের ক্লাস সমূহ নাচ, গান, ছবি আঁকা, ছড়া বলা, গল্প বলা, ম্যাজিকসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আলোচনা ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক বন্ধু মঙ্গল রায় জানান, একজন শিক্ষার্থীকে পরীক্ষামুখি মুখস্থ বিদ্যা, কোচিং নির্ভরতা, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ চক্র থেকে বের করে একজন প্রকৃত মানুষ তৈরী করাই তাদের লক্ষ। অভিভাবকগণ তার প্রিয় সন্তানকে মানুষ করতে চান। শিশুকে মানুষ করার দুটি কেন্দ্র পরিবার ও স্কুল। অভিভাবকদের সাথে নিয়ে শিশুদের বিকাশে সৃজনশীল ধারার সাথে পরিচয় করিয়ে তাদের বুদ্ধি বিকাশের মাধ্যমে প্রকৃত মানুষ করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।