হবিগঞ্জের কিন্ডারগার্টেনগুলোর সাফল্যগাঁথা (দুই)

আমাদের সন্তানদের সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে কোচিং বাণিজ্যের ধ্যান ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ হবিগঞ্জে কিন্ডারগার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদ্রষ্টা সৈয়দ এবাদুল হাসান। ১৯৭৬ সালে তিনিই প্রথম সন্ধানী সাংস্কৃতিক সংসদের মাধ্যমে হবিগঞ্জ শহরে শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নের সফল বাস্তবায়নে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) আজিজুর রহমানের সাথে আলোচনা করেন। ক্লাব কমিটির আহবানে আজিজুর রহমান শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে মতবিনিময় সভায় বসেন। কিন্তু সেই সভায় বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এ জেড আব্দুন নুর চৌধুরী বাচ্চাদের স্কুল খোলার বিপক্ষে মত দেন। ফলে ওই আলোচনা ভেস্তে যায়। পরে এসডিও আজিজুর রহমান প্রশাসনের মাধ্যমে স্কুল খোলার উদ্যোগ নেন। ১৯৭৭ সালের ১ জুলাই ‘দি রোজেস’ নামে হবিগঞ্জ শহরে প্রথম বাচ্চাদের স্কুল পথচলা শুরু করে। ওই সময়ে তিনি শিশু শিক্ষার্থীদেরকে অবৈতনিকভাবে কাব ট্রেনিং সহ শরীর চর্চা করাতেন। নিজ এলাকার বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী সংগ্রহ করে দি রোজেসে তিনি ভর্তিও করান। সেখানে তিনি বেশ কিছুদিন কাজ করেন। কিন্তু নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে না পেরে তিনি অনেকটা অতৃপ্তিতে ভোগেন। পরে তিনি হবিগঞ্জ পৌরসভার সাব এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ নকিবুর রহমানকে নিয়ে আবারো স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ১৯৯৬ সালের অক্টোবর মাসে শহরের মুসলিম কোয়ার্টারে ৪২ জন ছাত্র নিয়ে ‘শাইনিং স্টার’ নামে নতুন শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করেন। আর দি রোজেসের পর এটি হচ্ছে শহরে দ্বিতীয় কিন্ডারগার্টেন স্কুল। এ স্কুলে প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে হবিগঞ্জ এক্সপ্রেস সম্পাদক ফজলুর রহমান, রুকু তালুকদার, সুমী আক্তার, রুবী রানী রায়, সোহেলী চৌধুরী, শাহেদা আক্তার রোজী প্রমূখ শাইনিং স্টারের উদ্যোক্তা শিক্ষক ছিলেন। তাদের দক্ষতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, ত্যাগ, অক্লান্ত পরিশ্রম ও মেধার সমন্বয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি আজ তার স্বমহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।
শাইনিং স্টার স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সৈয়দ এবাদুল হাসান বলেন, সন্ধানী সাংস্কৃতিক সংসদ নামে আমাদের একটি ক্লাব ছিল। ওই ক্লাবের মাধ্যমে আমরা ১৯৭৬ সালে হবিগঞ্জে প্রথম শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার স্বপ্ন দেখি। এ লক্ষে আমরা তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক আজিজুর রহমানের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করলে তিনি আমাদের সংগঠনের সবাইকে নিয়ে করণীয় নির্ধারণে আলোচনায় বসেন। আলোচনায় এ জেড আব্দুন নুর চৌধুরী বাচ্চাদের স্কুল খোলার বিপক্ষে মত দিলে আমার স্বপ্ন সেখানেই থেমে যায়। পরে ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে ‘শাইনিং স্টার’ শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি। যার ক্যাম্পাস ছিল শহরের মুসলিম কোয়ার্টারে। বর্তমানে স্কুলটি শহরের শ্যামলী আবাসিক এলাকায় ‘শাইনিং স্টার মডেল স্কুল’ নামে পরিচালিত হচ্ছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমার স্বপ্ন ছিল স্কুলে ক্লাস বৃদ্ধি করে এসএসসি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার সেই স্বপ্ন অনেকটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কারণ বর্তমানে পারিপাশির্^ক অবস্থা ভাল নয়। স্কুলের শিক্ষার্থীদের অন্য স্কুলের অধীনে পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। এ বিষয়টিকে শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা পজেটিভভাবে নেয় না। অথচ হবিগঞ্জের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীই অন্য স্কুলের অধীনে সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে।
স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আজকাল প্রতিটি পাড়া মহল্লায় কিন্ডার গার্টেন স্কুল গড়ে উঠছে। এগুলোর অধিকাংশই ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত। অথচ আমি পুরোপুরি ব্যবসায়ীক উদ্দেশ্যে স্কুল প্রতিষ্ঠা করিনি। আমার উদ্দেশ্য ছিল উপরে উঠা। সুনাম অর্জন করা। কিন্তু হবিগঞ্জের পরিবেশ ঠিক তার উল্টো। এখানে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ছাড়া ঝুঁকি নিয়ে কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না। কেউ পড়ালেখার মান নিয়ে ভাবেনা। সরকারও এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে পজেটিভভাবে নেয়া হয় না।
শাইনিং স্টার মডেল স্কুলের শ্রেণি সংখ্যা ঃ শাইনিং স্টার মডেল স্কুলে প্লে থেকে স্ট্যান্ডার্ট ফাইভ পর্যন্ত পাঠদান করানো হয়ে থাকে। সেখানে সরকার নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও প্রত্যেক শ্রেণিতে ধর্ম, ইংরেজিতে কথা বলা এবং চারু কারুকলা সিলেবাসভূক্ত। সহপাঠ হিসেবে খেলাধুলা, শরীর চর্চা, সঙ্গীত প্রশিক্ষণ, আবৃত্তি, বক্তৃতা নিয়মিত চর্চা করা হয়।
ভর্তি পদ্ধতি ও ভর্তি ফি ঃ শাইনিং স্টার মডেল স্কুলে প্লে নার্সারীতে শুধুমাত্র মৌখিক এবং স্ট্যান্ডার্ট ওয়ান থেকে ভর্তির জন্য লিভিত ও মৌখিক উভয় মাধ্যমে মেধা যাচাই করে ডাক্তারী পরীক্ষার পর ভর্তি করা হয়।
প্রতি বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়। আর ক্লাস শুরু হয় জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে। প্রতি মাসের ২, ৬ ও ৯ তারিখে বেতন পরিশোধ করতে হয়। এছাড়া প্রতি মাসের ১৫ তারিখে ৫ টাকা এবং ২৫ তারিখে ১০ টাকা জরিমানা দিয়েও বেতন পরিশোধ করা যায়।
পরীক্ষা পদ্ধতি ও সময় সূচি ঃ সেমিস্টার পদ্ধতিতে বৎসরে ৩টি সাময়িক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ৩টি সাময়িক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র একিভুত করে চুড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছাড়া অনুষ্ঠিত ক্লাসে ৮০% উপস্থিত না থাকলে ছাত্রছাত্রীকে পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হয় না। ১ম সাময়িক পরীক্ষা ১ এপ্রিল থেকে ১০ এপ্রিল, ২য় সাময়িক পরীক্ষা ২০ জুন থেকে ৩০ জুন, ৩য় সাময়িক পরীক্ষা ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ২০ সেপ্টেম্বর, সমাপনী পরীক্ষা ৫ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়।
সাফল্য ঃ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ঈর্ষনীয় সাফল্য অর্জন করে আসছে। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় বিদ্যালয়ের সাফল্য শতভাগ। এছাড়াও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় এবং বিকেজিসি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় এ স্কুলের শিক্ষার্থীরা বরাবরই মেধা তালিকায় স্থানলাভসহ শীর্ষস্থান দখল করে আছে। এ সাফল্যের ধারা বহমান রয়েছে কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশন বৃত্তি পরীক্ষায়ও।
বিদ্যালয়টি শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার সপ্তাহের ৬ দিন ২ শিফ্টে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ১০টা এবং ২য় শিফ্ট সকাল ১১টা থেকে শুরু হয়ে চলে বেলা ৩টা পর্যন্ত। ক্লাস শুরুর ১৫ মিনিট পূর্বে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে স্কুলে উপস্থিত থাকতে হয়। পাঠদান কার্যক্রম শুরুর ৫ মিনিট পর কোন শিক্ষার্থীকে স্কুলে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। শুধু তাই নয় ছাত্রছাত্রী ব্যতিত অভিভাবক বা দর্শনার্থীর স্কুলে প্রবেশ নিষেধ। রয়েছে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের ব্যবস্থাও। অভিভাবকগণ ইচ্ছে করলে স্কুলের রিকশা ভ্যানের সেবা নিতে পারেন। এক্ষেত্রে রিকশা ভ্যান ভাড়া বাবদ ৪শ’ টাকা মাসিক ভাড়া অগ্রিম দিতে হয়।
বিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান সৈয়দ এবাদুল হাসান বলেন, শুধু সেবার উদ্দেশ্য নিয়ে ২০০১ সালে শহরের শায়েস্তানগর আবাসিক এলাকায় তিনি ‘গ্রীণলীফ ল্যাবরেটরি স্কুল’ নামে আরো একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। সমাজের সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের জন্যই এ স্কুল প্রতিষ্ঠা। এ স্কুল থেকে যা আয় হয় তার পুরোটাই এতিম শিক্ষার্থীদের দান করা হয়। স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এতিম শিশুদের এ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে ৯ জন শিশুকে ১ হাজার ৫শ’ টাকা করে এ সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। বিদ্যালয়টি যতদিন চলমান থাকবে তা থেকে অর্জিত টাকা এ খাতে ব্যয় করা হবে। তিনি আরও জানান, শহরের পইল রোডে বিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাসের জন্য তিনি ১শ’ শতক জায়গা ক্রয় করেছিলেন। কিন্তু সরকারি নানা সিদ্ধান্তের কারণে তিনি সামনে এগুতে পারছেন না। কিন্ডারগার্টেনের সরকারি রেজিস্ট্রেশন না থাকায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি এ ব্যাপারে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন।
সবশেষে তিনি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষা নিশ্চিতে স্কুলের পাঠ্যবই পড়ানোর উপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ব্যবসা মনে করে প্রতিষ্ঠান চালালে এ প্রতিষ্ঠানের স্থায়িত্ব থাকে কম। তাই হবিগঞ্জে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া অতিরিক্ত বাণিজ্যিক চিন্তা-ভাবনার কারণে এখন আর আগের মতো আন্তরিক শিক্ষকও পাওয়া যায় না। তাই আমাদের সন্তানদের সুশিক্ষা নিশ্চিতে কোচিং বাণিজ্যের ধ্যান ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শিশুর মেধার সুষ্ঠু বিকাশে বর্তমান মুখস্থ বিদ্যা অর্জনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে শিশুদের জ্ঞান অর্জনে পারদর্শী করতে হবে। তবেই সেই শিক্ষা আমাদের তথা দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।