পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যার আশাবাদ এক সময় দাঙ্গার দুর্নাম গুছিয়ে দেশের আদর্শ জেলা হবে হবিগঞ্জ

এসএম সুরুজ আলী ॥ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা (বিপিএম-পিপিএম সেবা) দায়িত্ব নেয়ার এক বছরে হবিগঞ্জে মামলার সংখ্যা কমেছে ৬০৯টি। পাশাপাশি সকল ধরণের অপরাধ কর্মকান্ড দমনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। তিনি দায়িত্ব নেয়ার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৭ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত জেলায় ২ হাজার ৮১৭টি মামলা দায়ের হয়েছিল। তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করার ১ বছরে মামলা দায়ের হয়েছে ২ হাজার ২০৮টি। এর মধ্যে জেলায় এক বছরে খুন হয়েছে ৬৩ জন। যার একটিও দাঙ্গায় নয়। আর আগের বছর খুন হয়েছিলেন ৮৭ জন। ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ১টি। ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৯৭টি। আর নারী নির্যাতন হয়েছে ২৮৬টি। অথচ ২০১৭ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত নারী নির্যাতন হয়েছিল ৩৭৫টি। ৮টি ডাকাতি মামলার মাঝে ২টি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এগুলো পারিবারিক ও লেনদেনের বিরোধের কারণে হয়েছে বলে তদন্তে প্রমাণিত হয়। সব মিলিয়ে এক বছরে মামলার সংখ্যা কমেছে ৬০৯টি। দাঙ্গা, মাদকসহ বিভিন্ন আইনের মামলা কমে গেছে। পাশাপাশি দেড় হাজার মামলার ওয়ারেন্ট কমেছে। উদঘাটন করা হয়েছে চাঞ্চল্যকর কয়েকটি হত্যা মামলার রহস্য। গ্রেফতার করা হয়েছে শতাধিক ডাকাত, মাদক ব্যবসায়ীকেও। ডাকাত গ্রেফতার করতে গিয়ে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে দুই ডাকাত নিহত হয়েছে। এসব ঘটনায় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। জেলায় মামলা কমে যাওয়ার পাশাপাশি চোর-ডাকাতদের গ্রেফতার করার ফলে চুরি-ডাকাতিও অনেকটা কমেছে। এ জেলার মানুষ এখন রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারছেন। তবে চুরি-ডাকাতিসহ সকল ধরণের অপকর্ম প্রতিরোধ করতে সকলকে সচেতন থাকবে হবে। কোথাও অপরাধ কর্মকান্ডের ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক পুলিশকে জানাতে হবে। পুলিশকে জানালে পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
সম্প্রতি জেলার আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ পত্রিকার এ প্রতিনিধির সাথে আলাপচারিতায় পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার পরপরই অপরাধ রোধে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করি। যেহেতু আমি এ জেলায় ইতোপূর্বে সার্কেল এএসপি’র দায়িত্ব পালন করেছি এ হিসেবে জেলা সম্পর্কে অবগত রয়েছি আমি। এছাড়া হবিগঞ্জ জেলায় জেএমবি’র প্রধান মাওলানা সাইদুর রহমানের বাড়ি হওয়ায় সেই চিন্তা মাথায় রেখে সর্বপ্রথম মাদ্রাসাগুলোতে জঙ্গীবাদের কুফল নিয়ে রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করি। ২৯টি মাদ্রাসায় এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করি। এ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়। তাদের মধ্যে খাতা, কলমসহ শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হয়।
এছাড়াও দাঙ্গা হাঙ্গামা, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, মাদক, বাল্যবিবাহ, ইভটিজিংসহ অপরাধ রোধে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে সেগুলোতে গিয়ে অপরাধের কুফল ও করণীয় নিয়ে রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করি। বিজয়ীদের খাতা, কলমসহ আকর্ষণীয় পুরস্কার প্রদান করি। বিজয়ী শিক্ষার্থীদের হাতে দাঙ্গা, জঙ্গি, মাদক বিরোধী স্লোগানের খাতা তুলে দেয়া হয়। পাশাপাশি রচনা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের হাতে মজাদার চকলেট তুলে দেন পুলিশ সদস্যরা। এর প্রভাব পড়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে। আমি ব্যক্তিগতভাবে জেলার প্রায় ৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছি। সেখানে জঙ্গিবাদ, দাঙ্গা, মাদক, বাল্যবিবাহ, প্রযুক্তির অপব্যবহার নিয়ে সচেতনতামূলক বক্তব্য প্রদান করেছি এবং শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের বক্তব্য শুনেছি। গণসচেতনতামূলক বক্তব্য প্রদান করে শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করি। শুধু আমি নই, আমার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপারসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা জেলার দুই শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন।
তিনি বলেন, যে এলাকায় যে ধরণের অপরাধ কর্মকান্ড হতো সেই এলাকায় সেই বিষয়ে সচেতনতামূলক বক্তব্য দেয়ার পাশাপাশি সামাজিক কর্মকান্ড করে যাচ্ছি। এসব কর্মকান্ড করার ফল মিলেছে। গত এক বছরে জেলায় মামলা মোকদ্দমাতো কমেছেই, কমেছে দাঙ্গা হাঙ্গামাও।
তিনি আরো বলেন, সিলেট বিভাগের মধ্যে হবিগঞ্জ জেলাটি গ্রাম্য দাঙ্গাপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। এখানে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বড় ধরণের দাঙ্গার সৃষ্টি হতো। একাধিক লোক মারা যেতো। এ জন্য বেশ দুর্নামও ছিল। তিনি বলেন, আমি যোগদানের পর প্রথম লক্ষ্যই ছিল এসব গ্রাম্য দাঙ্গা রোধ করা। তাই প্রথমে টার্গেটে নিয়েছি শিক্ষার্থীদের। তাদেরকে মোটিভেশন করতে পারলে সব ধরণের অপরাধের ক্ষেত্রেই ভাল ফল পাওয়া সম্ভব বলে আমি মনে করি। তারা যদি বাবা, চাচা, ভাইকে বলে তোমরা দাঙ্গায় গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হলে আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের পরিবারের কি হবে? এসব কথায় এর প্রভাব অনেক বেশি পড়বে। তাছাড়া অপরাধের কুফল সম্পর্কে জানা থাকার কারণে তারা বড় হয়েও এসব অপরাধ থেকে বিরত থাকবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গণসচেতনতামূলক এসব কর্মকান্ড করার পাশাপাশি বিভিন্ন পরিবহনে দাঙ্গা বিরোধী স্টিকার লাগানো হয়। বিট পুলিশিংয়ের মধ্যে বিভিন্ন গণসচেতনতামূলক সমাবেশ করা হয়। পাশাপাশি অসংখ্য মামলাও নিষ্পত্তি করা হয়েছে। তিনি বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করার ফল ইতোমধ্যে মিলেছে। গত এক বছরে দু’য়েকটি ছোটখাট দাঙ্গার বাইরে তেমন কোন ঘটনা ঘটেনি। এসব দাঙ্গায় কেউ মারা যায়নি। মামলার সংখ্যাও কমেছে প্রায় সাড়ে ৬শ’। তিনি বলেন, পুলিশ শুধু মামলাই নিষ্পত্তি করেনি, সামাজিক কর্মকান্ড ও দরিদ্রদের মধ্যে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। গত বছর জেলার ৬ হাজার লোকের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। এবারও শীতবস্ত্র বিতরণের পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি আরো বলেন, আইন শৃঙ্খলার উন্নতিকরণসহ সকল ক্ষেত্রেই পুলিশকে জনগণের সহযোগিতা করা উচিত। আমার বিশ^াস এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে পারলে এক সময় দাঙ্গার দুর্নাম গুছিয়ে হবিগঞ্জ দেশের আদর্শ জেলায় পরিণত হবে।