পাঠকের চিঠি

এস এম খোকন
উপমহাদেশের ফুটবলাঙ্গনে বি. রায় চৌধুরী হিসেবে পরিচিত ব্যাক্তিটির নামই হচ্ছে ভূপেন্দ্র রায় চৌধুরী। ছাত্র জীবনেই তিনি অংশ নিয়েছিলেন স্বদেশী আন্দোলনে। তার বীরত্বগাঁথার কথা আজও অনেকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। ১৩১৯ বাংলা সনের কোন এক শুক্রবার হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার ২নং উত্তর পশ্চিম ইউনিয়নের রঘুচৌধুরী পাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা বিশিষ্ট আইনজীবী স্বর্গীয় তারিনী রায় চৌধুরী। হবিগঞ্জ হাইস্কুলে দশম শ্রেণীতে অধ্যয়ন কালে ১৯৩১ সালে কংগ্রেসী আন্দোলনে যোগদেন তিনি। হবিগঞ্জে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সফরকালে জি.ও.সি এর দায়িত্ব পালন করেন। তিন বন্ধুকে নিয়ে তিনি ওই বছরই হবিগঞ্জ মহকুমা ট্রেজারী অফিসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে এস.ডি.ও কোর্টে হাজির করে। মাত্র আধঘন্টার মধ্যে এস.ডি.ও নবীব আলী তাদেরকে ১৫ মাসের জেল প্রদান করে শিলচর কারাগারে প্রেরণ করেন। ১১ মাস শিলচর জেলে কারাভোগের পর সিলেট কারাগারে তাদের স্থানান্তর করা হয়। বাকী ৪ মাস পর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে পরিক্ষায় অংশ নিয়ে প্রবেশিকা পাশ করেন। পরে হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজে ভর্তি হন এবং হবিগঞ্জ টাউন ক্লাব গঠন করেন। সেই সময় থেকেই কৃতি ফুটবলার হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এই সুবাদে ঢাকা জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ রায় বাহাদুর সতেন্দ্র নাথ দত্ত তার বরাবরে একটি টেলিগ্রাম করে খেলার যোগ্যতার প্রমাণ সাপেক্ষে কলেজ থেকে সকল সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা জানান। সেই মোতাবেক ঢাকায় গিয়ে খেলার নৈপুণ্য প্রদর্শন করে কলেজের উপাধ্যক্ষ ও স্পোর্টস ইনচার্জ এ.পি গুপ্তের মন জয় করতে সক্ষম হন। তখন থেকেই কলেজ কর্তৃপক্ষ তার অধ্যয়নসহ বিনা পয়সার থাকার ব্যবস্থা করে। ১৯৩৪ সালে তিনি আইকম পাশ করেন এবং ওই সালেই তার নেতেৃত্বে কলেজ টিম ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শীল্ড জিতে নেয়। তৎকালীন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য আর.সি মজুমদার তার খেলার নৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের দলে খেলার জন্য চাঁপ সৃষ্টি করেন। এর পর তিনি সেখানে ভর্তি হন এবং জগন্নাথ হল থেকে এ্যাথলেটিক্স সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ সালে ইংল্যান্ডের ‘আইলিংটন কোরিস্থিয়ান’ ক্লাব ঢাকা সফরকালে ঢাকা একাদশের সাথে এক প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে। এ খেলায় লেফট উইং থেকে বি. রায় চৌধুরীর যোগান দেয়া বল থেকে পাখি সেনের দেয়া একমাত্র গোলে তাদের দল জয়লাভ করে। ভারত বর্ষ সফরকালে ইংল্যান্ডের এটিই ছিল একমাত্র পরাজয়। ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বি.কম পাশ করে ওই সনেই কলকাতা ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের আমন্ত্রনে সেই ক্লাবে যোগদেন। তখন থেকেই উপমহাদেশে ফুটবলাঙ্গনে বি. রায় চৌধুরীর গৌরবোজ্জল অধ্যায় শুরু। তাকে দলে নেয়ার জন্য ক্লাবগুলোর মধ্যে টানাটানি পড়তো। পরে তিনি প্রথম সারির মোহনবাগান ক্লাবে যোগদান করে টানা ৪ বছর খেলেন। কর্ণার শর্ট থেকে প্রায়ই গোল পেয়ে তিনি কর্ণার শর্ট স্পেশালিষ্ট এর আখ্যা পেয়ে ছিলেন। ১৯৪২ সালে মহাত্মা গান্ধী ইংরেজ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলে গান্ধী গ্রেফতার হন। তখন দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বি. রায় চৌধুরী হবিগঞ্জ ফিরে এসে সিলেটের শশীভূষন রায়, দূর্গা কুমার ভট্রাচার্য্য, শতীন্দ্র মোহন দত্ত, নিকুঞ্জ বিহারী গুস্বামীসহ নেতৃবৃন্দের সাথে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন। এ আন্দোলনে হবিগঞ্জ থেকে ৭২ জন গ্রেফতার হয়েছিল। তিরিশের দশকে শিলচরে প্রথম ডিভিশন ফুটবল লীগ শুরু হয়। শুরু থেকেই অবিভক্ত ভারতের সিলেট, ব্র্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ থেকে ফুটবল ক্লাব এই লীগে অংশগ্রহণ করত। ওই ক্লাবগুলোর পক্ষে বানিয়াচংয়ে বি. রায় চৌধুরীও তার ছোট ভাই শচীন রায় চৌধুরী, কবির মিয়া, স্বদেশ নাগ ও হবিগঞ্জের অমিয় ভট্রাচার্য্য, টুলু রায় বিহারী ও সুবোধ দত্ত নিয়মিত খেলতেন এবং অসামান্য নৈপুণ্য দেখিয়ে তারা কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন। চল্লিশের দশকে বি. রায় চৌধুরী এশিয়াটিক ব্যাংকের ম্যানেজার পদে চাকুরী নিয়ে শিলচরে যান। কিংবদন্তী ফুটবলার হিসেবে সেখানে বরণীয় ও সমাদৃত হয়ে উঠেন এবং সংগঠক হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করেন। পরে তিনি এক্লাবের সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি আজীবন সদস্যপদ লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি অল ইন্ডিয়া ফেডারেশনের প্রেরণায় ১৯৪৬ সালে আসাম ফুটবল সংস্থা গঠন ও এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সভাপতি ছিলেন আসামের তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী ফখরুদ্দিন আলী আহমদ। যিনি পরর্তীতে ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে তিনি দেশ বিভাগের পর গ্রামের বাড়ী বানিয়াচংয়ে এসে বসবাস শুরু করেন। কংগ্রেসী স্বদেশী আন্দোলনের ফ্রিডম ফাইটার হিসেবে ভারত সরকার কর্তৃত মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সম্মানী ভাতা পেয়ে আসছিলেন। ভারতে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মহাসম্মেলনে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধি কর্তৃক তা¤্র মুকুট লাভ করেন।
৮০ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত কারণে ১৯৯২ সালের ২১ নভেম্বর নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন এই বরেণ্য ব্যাক্তি বি. রায় চৌধুরী। মৃত্যুকালে স্ত্রী সন্তানসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তিনি ব্যাক্তি জীবনে ৪ পুত্র ও ৪ কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। তার এক পুত্র বিধায়ক রায় চৌধুরী যুগ্মসচিব বর্তমানে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী হিসেবে কর্মরত আছেন। এছাড়া অন্যান্য সন্তানেরা শিক্ষকতাসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন।
লেখক ঃ সাংবাদিক ও সভাপতি, বানিয়াচং উপজেলা প্রেসক্লাব।