ঝলক গোপ পুলক
মা দুর্গা, যাকে ঘিরে ভক্তদের দীর্ঘ অপেক্ষা, অপেক্ষা পরিণত হয় প্রতীক্ষায় আর প্রতীক্ষার দীর্ঘ দিবস – রজনী অতিক্রান্ত করে মা দুর্গা আসে ভক্তদের হৃদয়ের দ্বারপ্রান্তে। ভক্তরা আকুল হয়ে অপেক্ষায় থাকে কখন মাকে বরণ করবে, কখন মাকে কাছে পাবে। মা আসবে, মা তার ভক্তের বিপদ-আপদ দূর করবে এই প্রত্যাশা নিয়ে দিন কাটায় সনাতনীরা।
মা দুর্গা নামকরণ হয়েছিলো যখন মা দুর্গা দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেন তখন। এই দুর্গম নামক অসুর জীবকে দূর্গতি প্রদান করতো। তাই মা দুর্গা সন্তানের মঙ্গলের জন্য দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেন।
এই দুর্গম অসুরের দুই রূপ; সংসার পথে এর নাম স্বার্থান্ধতা আর আধ্যাত্মিক পথে এর নাম অবিদ্যা। *১
দুর্গা শব্দের আরেকটি শব্দ দুর্জ্ঞেয়। মায়ের তত্ত্ব দুরধিগম্য। আমাদের স্থূল জ্ঞানের সামর্থ্য নাই মায়ের তত্ত্ব জানবার যদি না মা আমাদের কৃপা করেন।
মা মহিষাসুর নামের অসুরকে বধ করে স্বর্গ উদ্ধার করেছিলেন বলে মাকে মহিষাসুরমর্দিনী নামেও সম্বোধন করে অনেক ভক্তরা। এছাড়াও মাকে শিবানী, বিশেশ্বরী, জগজ্জননী, পরমেশ্বরী নামেও সম্বোধন করা হয়ে থাকে।
মায়ের দশ হাতে থাকে দশটি অস্ত্র। ডান দিকের পাঁচ হাতের অস্ত্রগুলি উপর হতে নিচের দিকে ত্রিশূল, খড়গ, চক্র, তীক্ষ্মবাণ ও শক্তি। বাম দিকের পাঁচ হাতের অস্ত্রগুলি খেটক (ঢাল), ধনু, পাশ, অঙ্কুশ ও ঘন্টা। এই অস্ত্রগুলি দিয়েই মা ভক্তদের অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা করেন। বর্তমানে প্রত্যেক মায়েরা তাদের সন্তানের জন্য সবসময় অসুরদের সাথে যুদ্ধ করছেন। বস্তুত আমরা বর্তমান সমাজেও মায়েদেরকে দুর্গা রুপেই পরিলক্ষন করছি।
বছর ঘুরে আবারও মা দুর্গা এসেছে ভক্তের হৃদয়ের দ্বারপ্রান্তে। সেই খুঁটি পূজার থেকেই শুরু হয় মা কে আরাধনার আনুষ্ঠানিকতা। ভক্তদের মন জুড়ে বিরাজ করে নানান উৎকন্ঠা। ভক্তরা প্রস্তুত হয় মাকে তাদের ঘরে তুলে নিতে, মাকে আরাধনা করতে।
এর কিছুদিন গত হতেই কৃষ্ণপক্ষের আমাবস্যা তিথিতে আসে মহালয়া। মহালয়া একটা ইঙ্গিত যে দেবীপক্ষ এসে পড়েছে। মহালয়া থেকেই শুরু হয় দেবীপক্ষের শুভ সূচনা। সেই ছোটবেলা থেকে ভোর বেলা ওটেই দূরদর্শন যন্ত্রে দর্শন করতাম দূর্গতিনাশিনী মা দুর্গাকে আর শুনতাম পংকজ মল্লিকের সুরে, বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের গলায় শরীরে শিহরণ জাগানো মহিষাসুর-মর্দিনী আর সেই লাইনটুকু ‘যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরুপেণ সংস্থিতা, নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ’। তারপরেই শুরু হতো সঙ্গীতানুষ্ঠান যেখানে একটা গান সবসময়ই আমার মনে দুর্গা পূজোর আমেজ জাগাতো, সেই গানটা হলো, ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু, মাতলো রে ভুবন বাজলো তোমার আলোর বেণু’।
এই ঐতিহাসিক মহালয়া ভারতে ১৯২৯ সালে লেখা হয় এবং ১৯৫২ সালে প্রথম পংকজ মল্লিক এর সুরে এবং বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের গলায় প্রথম রেকর্ড করা হয়। ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে চলে আসছে এই বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। কালের বিবর্তনে এখনো সেই একই গলায় চলে আসছে মহালয়া। সনাতনী প্রাণ যেখানে বসেই এ গলায় মহালয়া শুনে সেখানটাই যেনো মন্দির হয়ে যায় মনে হয় মন্দিরের সুগন্ধিতে সুগন্ধে ভরে উঠেছে চারিদিক। অন্যদিকে মহালয়ার দিন পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে তর্পন করা হয়ে থাকে।
তারপর পূজো আস্তে আস্তে এগুতে থাকে মানুষের মধ্যে শুরু হয় এক অন্যরকম আমেজ সবাই পূজোর পোষাক-আশাক কিনতে মত্ত হয়ে পড়ে। বাদ পড়ে না রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এতিম শিশুটিও, বিভিন্ন সনাতনী সংগঠন থেকে তাদেরও পূজোতে নতুন পোষাক দেওয়া হয়।
মনে হয় এ যেনো সনাতনীদের প্রাণের মিলনমেলা। হাজারো সনাতনী প্রাণ হাজারো ক্লান্তি, আর্তনাদ, দুঃখ, কষ্ট ভুলে মত্ত হয় আনন্দের এই মহোৎসবে।
সৃষ্টির প্রথম যুগে পরমাত্মা বিষ্ণু বৈকুন্ঠের আদি বৃন্দাবনে প্রথম দুর্গা পূজা করে। ২*
তারপর ত্রেতাযুগে রাবণ বধের জন্য শ্রী রামচন্দ্র দেবীর অকাল বোধনের করে শারদীয় দুর্গাপূজার প্রচলন করে। ৩*
এরপর বিষ্ণুর পরে মধু ও কৈটভ নামের দুই অসুরের ভয়ে ব্রহ্মা দ্বিতীয় দুর্গা পূজা করে। ৪*
অতঃপর ত্রিপুরা নামের এক অসুরের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শিব তৃতীয় দুর্গাপূজা করে। ৫*
এরপর সারাদেশে তথা সারাবিশ্বের মানুষের মঙ্গল কামনায় ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত মায়ের আরাধনা চলে।
পরিশেষে মায়ের দশমী পূজা বিহিত করে ভক্তরা অনেক ত্যাগের মধ্যে দিয়ে মাকে বিসর্জন দিয়ে পরের বছরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে।
ঈশ্বরকে মাতৃরূপে আরাধনা বিশ্ববাসীর জন্য সনাতন ধর্মের অভূতপূর্ব ঘোষণা।
বিশ্বমানবতাবোধের প্রসারে বিশ্বজনননী পূজা সফল হোক এই নিরন্তর প্রার্থনা।
তথ্যসূত্রঃ ১* মা দুর্গার কাঠামো – ডঃ মহানামব্রত ব্রহ্মচারী
২* ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে
৩* কৃত্তিবাসের রামায়ণ
৪* ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে
৫* ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে

লেখক পরিচিতি : ঝলক গোপ পুলক
সাহিত্য ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক – বর্ণমালা খেলাঘর আসর
সদস্য – চৌধুরী বাজার সার্বজনীন পূজা কমিটি, হবিগঞ্জ