উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহ সোহান আহমেদ মুছাসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা

নবীগঞ্জ প্রতিনিধি ॥ নবীগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) ও এসআইকে কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করার ঘটনায় তালিকাভূক্ত সন্ত্রাসী এবং উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি শাহ সোহান আহমেদ মুছার মা এবং ৩ বোনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঘটনার সময় ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু মুছাকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন- মুছার মা শামছুন্নাহার (৫০), বোন মৌসুমী আক্তার (২৬), শাম্মী আক্তার (২২) ও তন্নী আক্তার (১৯)। গতকাল শুক্রবার তাদেরকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
হামলার ঘটনায় গতকাল শুক্রবার দুপুরে এসআই ফিরোজ বাদী হয়ে নবীগঞ্জ থানায় ১৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরো ৭-৮ জনকে আসামি করে পুলিশ অ্যাসল্ট মামলা দায়ের করেন। মামলাটি রেকর্ড হওয়ার পর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব প্রদান করা হয় এসআই সামছুল ইসলামকে। এর আগে শুক্রবার সকালে সন্ত্রাসী মুছাকে গ্রেফতারপূর্বক শাস্তির দাবিতে নবীগঞ্জ-আউশকান্দি সড়কের সিএনজি স্ট্যান্ডের শ্রমিকরা নবীগঞ্জ শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে। এ সময় বক্তারা মুছা কর্তৃক সিএনজি শ্রমিক ফজলুর উপর সন্ত্রাসী হামলাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ের ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
নবীগঞ্জ থানার ওসি মো. ইকবাল হোসেন জানান, দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে কুপিয়ে জখমের ঘটনায় জড়িত থাকায় বৃহস্পতিবার রাতেই তাদেরকে আটকের পর রাতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী মুছাকে গ্রেফতারে রাতভর চিরুনী অভিযান পরিচালনা করে পুলিশ। মুছাকে ধরতে এই অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি। তিনি আরো জানান, সন্ত্রাসী মুছার আক্রমণে পুলিশের দুই কর্মকর্তা আহত হওয়ার ঘটনা জানতে পেরে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা বৃহস্পতিবার রাতে নবীগঞ্জে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। আহত এসআই ফখরুজ্জামানের অবস্থার উন্নতি হলেও ওসি (তদন্ত) উত্তম কুমার দাশ সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তারও অবস্থার উন্নতি হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী মুছাকে ধরতে শহরের সালামতপুর এলাকায় ব্র্যাক অফিসের কাছে তার দোকানে যান নবীগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) উত্তম কুমার ও এসআই ফখরুজ্জামান। তখন মুছা দোকান থেকে বেরিয়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। ঘটনার পরপরই মুছার বাড়িতে অভিযান চালায়। সেখান থেকে মুছার একটি প্রাইভেটকার ও একটি মোটরসাইকেল জব্দ করে পুলিশ। সেই সাথে পুলিশ মুছার মা ও তিন বোনকে আটক করে।
কে এই সন্ত্রাসী মুছা ঃ নবীগঞ্জ পৌর এলাকার শহরতলী সালামতপুর গ্রামের খুর্শেদ মিয়ার পুত্র শাহ সোহান আহমেদ মুছা সবার কাছে সন্ত্রাসী মুছা ও মাদক ব্যবসায়ী হিসাবেই পরিচিত। তার আরেক পরিচয় সে একজন খুনি। ছোটবেলায় মা ও বাবার যোগসাজশে নিজের সৎ ভাইকে হত্যার মাধ্যমে অল্প বয়সেই তার অপরাধ জগতে প্রবেশ। পরে নবীগঞ্জের জনপ্রিয় ছাত্রলীগ নেতা হেভেন হত্যার সাথেও জড়িত ছিল মুছা। মুছা তার সৎ ভাইকে হত্যা দায়ে জেল খেটে এসেই এলাকায় বেপোয়ারা হয়ে ওঠে। মুছা নামটি শুনলেই সাধারণ মানুষ আতংকে ওঠেন। প্রতিনিয়তই শহর এবং বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সাথে লিপ্ত হয়ে পড়ত সে। মুছা সরকার দলীয় ছাত্রলীগ রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। সে ২০১৪ সালে উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা হেভেন চৌধুরীরকে শহরে প্রকাশ্য দিবালোকে হামলা চালিয়ে হত্যার মাধ্যমে আবারো শহরসহ হবিগঞ্জ জেলাজুড়ে আলোচনায় চলে আসে। মুছা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু দলের নেতৃবৃন্দ নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, মুছা কোনো সময় দল করত না। এক সাবেক ছাত্রলীগ নেতার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে সে সাবেক কমিটির সহ-সভাপতি পদ পেলেও সেই কমিটি জেলা থেকে অনুমোদন পায়নি। সে আগে এবং পরে রাজনীতির সাথে জড়িত নয়। একজন সন্ত্রাসী, মোটরসাইকেল চোর, চাঁদাবাজ, ডাকাত এবং মাদক ব্যবসায়ী হিসাবেই সবাই তাকে চেনেন। নবীগঞ্জে সন্ত্রাসী মুছা নামে পরিচিতি পায় সে। আলোচিত হত্যা মামলাসহ অসংখ্য মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সে চোরাই মোটরসাইকেল এবং গাড়ি বিক্রির সিন্ডিকেটের সাথেও জড়িত ছিল। বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি পুলিশ ও র‌্যাবের যৌথবাহিনী সন্ত্রাসী মুছার পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলে। রাত প্রায় সাড়ে ১২টা থেকে পৌনে ২টা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় যৌথবাহিনী। এ সময় মুছার স্বীকারোক্তিতে ৫৬৭ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। এক বছর আগে মুছা দিনদুপুরে প্রকাশ্যে নবীগঞ্জ শহরের ওসমানী রোডের হীরা মিয়া গার্লস স্কুলের সামনে অস্ত্র দেখিয়ে ৩টি দোকানে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট করে ৩টি মোটর সাইকেলসহ ৭ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনার কয়েকদিন আগে গত ১২ ডিসেম্বর বিকালে মুছা তার গ্রামের শ্রমিক নেতা হেলাল আহমদের বাড়ির চলাচলের সীমানায় বেড়া দিয়ে ওই পরিবারের চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে দেয়। এ বিষয়ে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এসআই সুজিত চক্রবর্তীর নেতৃত্বে একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে মুছা ও তার পরিবারের সদস্যদের রোষানলে পড়ে। এক পর্যায়ে মুছাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করলেও তার হুমকি-ধামকিতে ফিরে আসতে বাধ্য হয় পুলিশ। মুছার সাম্প্রতিক সময়ের এসব সন্ত্রাসী কর্মকা-ে নবীগঞ্জ শহরে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।
স্থানীয় লোকজন জানান, মুছা এখন একটি আতংকের নাম। অভিযোগ রয়েছে, মুছা তার চাচা নিজাম উদ্দিনের বাড়িঘর জোরপূর্বক দখল, ফিশারির মাছ লুট, কয়েক লক্ষাধিক টাকার গাছ জোরপূর্বক কেটে নিয়েছে। এর প্রতিবাদ করায় ধারালো ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে তার চাচাদেরও হুমকি দেয় সে। প্রাণের ভয়ে তারা বাড়িঘর ছাড়া রয়েছেন। গত বছর ইয়াবাসহ শ্রীমঙ্গল থানা পুলিশ মুছাকে আটক করেছিল।