তাহমিনা বেগম গিনি
এই কিশোরী মেয়েগুলো বাল্যবিবাহের শিকার হবে। কারণ প্রতিটি অভিভাবক চাইবেন তার কন্যাকে নিরাপদে রাখতে। গ্রামের, শহরের অনেক পিতামাতা এখনো মনে করেন একমাত্র বিবাহই মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু বাল্যবিবাহ যে প্রকারান্তরে যৌন নির্যাতন তা অনেকেই মানতে চান না।
ভেবেছিলাম অন্য কিছু লিখব। পূন্যকে সামনে দেখেই মনে হল ওদের কথাই লিখি না কেন ওরা তো আমাদের বাগানের ফুল। বিভিন্ন সময় মহিলা অধিদপ্তরের নারী উন্নয়নের বিভিন্ন কর্মকান্ড পত্রিকা, ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারি। সরকারের নীতিমালার সফল প্রনয়ন এবং প্রয়োগ হয়তো এইসব। হবিগঞ্জের মেয়েরা মহিলা অধিদপ্তরের মাধ্যমে হাতে কলমে শিখে যদি নিজেরা স্বনির্ভর হতে পারেন-এর চেয়ে ভালো আর কিছু নেই। মাঝে মাঝে আমাকে উপ-পরিচালক মহোদয় কোন কোন কর্মকান্ডে শরীক করেন। তেমনি একটি নতুন প্রকল্পে সেদিন গিয়েছিলাম পইল উচ্চ বিদ্যালয়ে। বিষয়টি ছিল “মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালীন প্রজনন স্বাস্থ্য এবং স্যানিটারী টাওয়েল প্রদান।” স্বাধীনতার ৪৮ বছরে কোন সরকারকে দেখিনি মেয়েদের জন্য এমন একটি প্রকল্প গঠন করতে। যে বিষয়টি ছিল লুকায়িত। বলা যাবে না, শোনা যাবে না, দেখানো যাবে না, দেখে ফেললেও লজ্জার সীমা থাকবে না, লোকে বলবে লজ্জাহীনা। তেমন একটি বিষয় নিয়ে বিদ্যালয়ের পুরুষ শিক্ষক, অতিথি সবার সামনে আলোচনা এবং ২০০ ছাত্রীকে স্যানিটারী টাওয়েল প্রদান (টাওয়েল বলতে প্যাড)-সত্যিই খুব ভালো লেগেছিল সেদিন। পাকিস্তান আমলে আমরা যখন স্কুলে পড়েছি তখন ক্লাস সিক্স-সেভেনে “গার্হস্থ্য বিজ্ঞান” নামে একটি পাঠ্যপুস্তক ছিল মেয়েদের। ঘর কন্যার যাবতীয় কিছু যেমন- সেলাই, রান্না আরো অনেক কিছুর সাথে একটি অধ্যায় ছিল “ঋতুচক্র”। স্কুলে আমাদের কোনদিনও এই অধ্যায়টি পড়ানো হতো না। শিক্ষয়িত্রীরা এ বিষয়ে কোন আলোচনা করতেন না। এমনকি বাড়িতে মা-রাও এই অধ্যায় কোনদিন খুলে দেখতেন না। একটি কথা বলতে দ্বিধা নেই সেই যুগের আমরা এখনকার ডিজিটাল ছেলেমেয়েদের মতো সর্ব বিষয়ে (?) পন্ডিত ছিলাম না। যাই হোক আমি বলব মেয়েদের জন্য কেউ তো ভাবছেন। যদি বলি বর্র্তমান সময়ে নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন, শিশু হত্যা এবং বিভিন্ন কারণে নারী, শিশুদের আত্মহত্যার পরিমাণ অত্যাধিক বেড়ে যাওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষ অনেক কিছু নিয়ে ভাবছেন। নারী শিশুদের সুরক্ষার কথা ভাবছেন। কিভাবে বিভিন্ন রোগ ব্যাধি থেকে দূরে থাকা যায়? কিভাবে মেয়েদের মাতৃত্ব সুরক্ষিত করা যায়? সে জন্য চেষ্টা করছেন। পইল স্কুলে আমি সেদিন মেয়েদের বলেছিলাম “তোমরা আজ লজ্জা পাবে না। শারিরীক বৃদ্ধির একটি চক্র এই ঋতুচক্র। পিরিয়ড না হলে তুমি জন্ম নিতে পারতে না। তোমার মা বাবা ভাই কেউ পৃথিবীতে আসত না। শিশুটি ভুমিষ্ট হওয়ার সময় সারা অঙ্গে এই রক্তের প্রলেপ লাগিয়েই এই ধরাধামে আগত হয়।” তবে শহরের মেয়েদের তুলনায় গ্রামের মেয়েরা এই সময় বেশি অবহেলিত থাকে। ঠিকভাবে তারা পরিচর্যিত হয় হয় না। যার কারণে বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তারা বিভিন্ন মেয়েলী অসুখে আক্রান্ত হয়। স্যানিটারী টাওয়েল স্বাস্থ্য সম্মত নেপকিন। বাজারে বিভিন্ন নেপকিন উচ্চ মূল্য বিধায় সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নেই। কিন্তু মহিলা অধিদপ্তরের নিজস্ব যে টাওয়েল তার মূল্য অনেক কম। মেয়েরা মোবাইলে মাসে যে টাকা খরচ করেন তার চেয়ে অনেক কম মূল্যে ক্রয় করতে পারবেন। নাম “প্রজাপতি”। আমি মা বাবা সবাইকে বলছি লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই- আপনার কন্যা সন্তানের প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষিত করার দায়িত্ব আপনাদের। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না।
ইতিমধ্যে সবাই জেনে গিয়েছেন তারপরও লিখছি- কন্যা শিশু প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষা আমরা তখনই করতে পারবো যখন কন্যা শিশুটিকে আমরা রক্ষা করতে পারবো। বানিয়াচং উপজেলার সুনারু গ্রামে স্কুলগামী তিনজন ছাত্রীর সাথে যে ভয়ঙ্কর আচরণ হয়েছে, তাতে সকল অভিভাবকবৃন্দ চিন্তিত। শুনশান রাস্তায় সিএনজি চালকের অপহরণের উদ্দেশ্যে একজন ছাত্রীকে টানাহেচড়া বিষয়টি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। চিৎকার করেও তারা রক্ষা পেত না যদি আর একজন সিএনজি চালক সেখানে না আসতেন। দৈব্যই বলব রক্ষাকর্তা সিএনজি চালককে। এবার না হয় মেয়েগুলো রক্ষা পেল। কিন্তু বারবার কে তাদের রক্ষা করবে? আমার জানামতে ঐ এলাকার বাসিন্দারা প্রায় মধ্যবিত্ত, নি¤œমধ্যবিত্ত। কিন্তু সন্তানদের লেখাপড়া শেখাবার ইচ্ছা অভিভাবকবৃন্দের যেমন তেমনি ছেলেমেয়েরাও স্কুলে যেতে আগ্রহী। কিন্তু এই ঘটনা সব কিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। হবিগঞ্জবাসী আমরা জানি এবং মানি আমাদের বর্তমান পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তা ব্যক্তি এসপি মহোদয় অত্যন্ত কর্মতৎপর কর্মকর্তা। এবং আরো যারা পুলিশ প্রশাসনে আছেন কর্মকর্তা হিসেবে তারাও যে কোন অপরাধ দমনে তৎপর। এসপি মহোদয়ের কাছে একজন অভিভাবক, মা হিসেবে অনুরোধ করছি আমাদের গ্রামের মেয়েদের শিক্ষার পথ যেন রুদ্ধ না হয়। অপরাধীকে গ্রেফতার করে স্কুলগামী মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন আশা করছি। তা না হলে এই কিশোরী মেয়েগুলো বাল্যবিবাহের শিকার হবে। কারণ প্রতিটি অভিভাবক চাইবেন তার কন্যাকে নিরাপদে রাখতে। গ্রামের, শহরের অনেক পিতামাতা এখনো মনে করেন একমাত্র বিবাহই মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু বাল্যবিবাহ যে প্রকারান্তরে যৌন নির্যাতন তা অনেকেই মানতে চান না। পুলিশ প্রশাসনের সদয় এবং অভিভাবক সুলভ মনোভাব আমাদের এই স্কুলগামী কন্যাদের সব রকমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে আশা করছি। শুধু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একা কিছু করতে পারবেন না, আসুন পিতা মাতা সুশীল সমাজ, প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট সবাই একত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নারী, শিশুদের উন্নয়নের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত করতে এগিয়ে আসি। বেগম রোকেয়ার কথা দিয়ে শেষ করছি- “আমাদের কন্যাদিগকে লেখাপড়া শিখাইয়া শিক্ষিত করিয়া ছাড়িয়া দিন। তাহাদের ভাত কাপড় তাহারাই যোগাড় করিয়া লইবে।”