অতীতের সেই সোনালি যুগের সামাজিক সম্প্রীতির সম্যক ধারণা নূতন প্রজন্মের নিকট আজ অজানা। আমরা আবারো সেই সোনাঝড়া অতীতে ফিরে যেতে চাই। বিভাজন নয়, স্নেহ, মমতা, শ্রদ্ধা ভালবাসায় অতীতের মতই সিক্ত হতে চাই পুনর্বার

ডা. মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহাব

সবেমাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছি। বয়স তখন হয়ত ছয় ছুঁই ছুঁই। এর আরো বছর দুয়েক আগের স্মৃতিও আবছা মনে আছে। দাদা তখনো বেঁচে আছেন। আমার প্রজন্মে আমি সবার বড়। সুতরাং সকলের দৃষ্টিতে এ প্রজন্মে আমি বংশের প্রথম প্রদীপ। দাদা দাদী, তিন চাচা, ফুফুরা এবং বড় চাচী কি পরিমাণ যে আদর করতেন বলাই বাহুল্য। তাছাড়া একান্নবর্তী পরিবারের একজন কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে পরম এ সৌভাগ্য ছিল দারুণ উপভোগ্য। অতিরিক্ত বিরক্তি করার কারণে দাদী একদিন গালে হাল্কা একটা ঠোকর দিয়েছিলেন, অতঃপর দাদা দাদীকে তিন উঠোন দৌঁড়ানি দিয়েছিলেন, যে গল্প দাদী প্রায়শই বলতেন। বড় চাচা কোনদিন একটু ধমক দিয়ছেন এ অভিজ্ঞতা হয়নি কখনো। আমার রাগী এ চাচা মাঝে মাঝে রাগ করে ভাত না খেলে সহসা কেউ রাগ ভাঙ্গাতে পারতেন না, কিন্তু আমি চাচার হাত ধরে একবার বললেই নিঃশব্দে উঠে খেতে বসে যেতেন। এখন বুঝতে পারি আদরের পাল্লাটুকু কি পরিমাণ ওজনদার ছিল।
দাদা বুড়ো বয়সে উঠোনে সারাদিন বাঁশের বেত তুলতেন আর সুন্দর সুন্দর বেতের ছাকা, ওড়া, চালুন এসব তৈরি করতেন। বয়স হয়ত ছিল সত্তুরের আশপাশ। দাদাকে খুব একটা একা দেখতাম না, সবসময় পাশে গ্রামের দু’একজন সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে ঘিরে বসে নানাবিধ গল্প করতে দেখতাম। সবসময় ফসি হুক্কার ধোঁয়া উৎগীরণ চলত যার বিরক্তিকর কলকি সাজানোর ঘন ঘন দায়িত্বটা পড়ত আমার উপর। গ্রামের হিন্দু মুসলিম তখন প্রায় ফিফটি ফিফটি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আমার বিবেচনায় এযাবতকালের ভিতরে তখন ছিল একেবারে তুঙ্গে। ঐতো সারমুণি দাদা, ডাক্তার নন্দলাল দাদা, গোবিন্দদাদা, প্রফুল্লদাদা সবাই কত না আপন ছিলেন! তদ্রুপ বাবা ও চাচাদের সমবয়সী কাকারাও ছিলেন ঘনিষ্ঠজন। যেমন সত্য কাকা, হরেকৃষ্ণ স্যার, গঙ্গাধর কাকা, দয়ানন্দ কাকা।
তাছাড়া মুসলমান অনেকেই ছিলেন যাদের সাথে গোষ্ঠী বা রক্ত সম্পর্ক ছিল না কিন্তু ছিল একই পরিবারের মত আত্মার এক দারুণ বন্ধন। যেমন আয়ুব আলী চাচা, মোক্তার চাচা, আঞ্জব আলী চাচা, মনাফ চাচা প্রমুখ।
যা বলছিলাম, দাদাকে কোনদিন খুব একটা একা খেতে দেখতাম না। খাবার সময় দুপুর বা রাতে কেউ না কেউ সাথে থাকতেনই। দাদা আর আমার ভোজন চলত একই পাতে। তৎকালীন প্রচলিত গর্ত থালায় হাতের কব্জি ডুবিয়ে দুধভাত খাওয়ার সুখস্মৃতি আজো অম্লান। আমার বাবারও একা খাওয়ার অভ্যাস ছিলনা, যে অভ্যাসটা পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে কিছুটা আয়ত্ত করতে পেরেছি বলে আমারও মনে হয়। অন্যদিকে জীবনের প্রথম দশক কেটেছে দাদীর আঁচলের আচ্ছাদনেই। তাই দাদীর চতুর্পার্শস্থ ঘনিষ্ঠ হিন্দু মুসলিম মহিলাজগতের সামাজিক অভিজ্ঞতায় অনেকটাই অকালপক্ব বনে গিয়েছিলাম বৈ কি! দাদী অনেক খনার বচন জানতেন, যার মর্মার্থ এখন অনেকটাই উপলব্ধি করতে পারি।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের তৎকালীন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল নৌকা এবং লঞ্চ-স্টীমার নির্ভর। বাড়ি থেকে এক কিলো দূরে লঞ্চ স্টেশন। আশেপাশের গ্রামের ভোরে ঢাকাগামী লোকজন আগেরদিন সন্ধ্যায় আত্মীয় অনাত্মীয় নির্বিশেষে আমাদের বাংলাঘরে মুসাফির হিসেবে অবস্থান করাটা ছিল নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। হিন্দু মেহমান হলে খাওয়ার দায়িত্ত পড়তো পাশের বাড়ির হিন্দু পরিবারের উপর আর হিন্দু বাড়িতে কোন মুসলমান মেহমান চলে আসলে দায়িত্বটা চলে আসত আমাদের মত মুসলমান বাড়ির উপর।
আমাদের প্রত্যন্ত ভাটি অঞ্চলটা লেখা পড়ায় পিছিয়ে পরা হলেও তখন গোলায় ধান ছিল, গোয়ালে গরু ছিল আর পুকুরে ছিল মাছ আর মাছ। সুতরাং খাওয়া দাওয়ায় কোনরুপ হিসেব কিতেব ছিল না, পাশাপশি ছিলনা শান-সৌকত বা আভিজাত্যেরও কোন অসম প্রতিযোগিতা।
প্রায় প্রতিটা সচ্ছল বাড়িতেই গরু রাখাল সহ তিন চারজন ষান্মাসিক কাজের লোক থাকতেন যাদেরকে বয়সানুপাতে ভাই বা চাচা-মামা বলে ডাকতে হত। খাবার সময় তাদেরকে সহ ঘরের সকল পুরুষ এক সাড়িতে গোল হয়ে পিড়িতে বসে খাওয়ার অনুপম সুখদৃশ্য আজো স্মৃতিপটে ভাসমান। বাবা মাঝে মাঝে বাজার থেকে কাজের লোকদের সহ সবার জন্য নুতন কাপড় চোপড় আনতেন। তখন কেমন যেন এক আনন্দের ফোয়ারা বয়ে যেত। বাড়ির সবার মত ছয় মাসের মেহমান তথা এ কাজের লোকগুলিও আমাদেরকে দারুণ আদর করতেন। মাঝে মাঝে অবসরে রাতে উঠানের কোণে বসে উনারা অনেক গান, গল্প, পালাগান শোনাতেন মানের দিক থেকে যা প্রশংসার যথেষ্ট দাবি রাখে।
যে উদ্দেশ্যে আমার এতসব কথাবার্তার অবতারণা। তখন কিন্তু পুরোটা পাড়া, মহল্লা, গ্রাম বা এলাকা তথা সারাটা দেশ এমনতর আত্মিক বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। পারিবারিক, সামাজিক সম্প্রীতি ছিল নিখুঁত। কোন বাড়িতে আগুন লাগলে সবাই ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী বা বংশ নির্বিশেষে ঝাপিয়ে পড়ত। কোথাও ডাকাতের আক্রমণ হলে প্রাণের মায়া উপেক্ষা করে মোকাবেলা করত নির্দ্বিধায়। সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে আন্তরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত অকপটে। অসুখ বিসুখে অর্থ, শ্রম, উপদেশ দিয়ে সহায়তা করত অবলীলায়। কারো গায়ে কোন ধরনের রাজনৈতিক গন্ধ ছিল না। ঐতো ১৯৭১ সালে তেমনিভাবে শতকরা নিরানব্বইজন একইভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করেছিল যার সুফল কিয়দংশ হলেও আমরা ভোগ করে চলেছি।
কিন্তু আজ দুঃখ হয় অতীতের সেই পারিবারিক, সামাজিক বন্ধনে যেন একটা ভাঙ্গন ধরেছে, পূর্বেকার সেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এখন আর তেমনটা নেই, গ্রামের সেই পারস্পরিক স্নেহ, মমতা, শ্রদ্ধা সবকিছুতেই যেন ভাটা পড়েছ। ঘৃণিত বিভাজন সমগ্র জাতিকে দ্বিখন্ডিত, ত্রিখন্ডিত করে ফেলেছে। শুধু রাজনৈতিক কারণে প্রতিটি পরিবারে, সমাজে, গ্রামে, উপজেলায়, নির্বাচনী এলাকায় বিভাজন বিদ্যমান। ত্যাগ নয় বরং ভোগই এখন অনেকাংশে রাজনীতির আসল লক্ষ্য। পণ্য হিসেবে রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের দখলে। মুনাফার উদ্দেশ্যে ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ ফর্মুলাকে কাজে লাগিয়ে জমি দখল, নদী দখল, জলমহাল ও বালুমহাল দখলের নিমিত্তে অশিক্ষিত বর্বর মাস্তানদের ব্যবহার করা হচ্ছে অহর্নিশ। কেবলমাত্র ব্যক্তিগত ফায়দা হাসিলের জন্য খুন, রাহাজানি, মাদক ব্যবসার মত জঘন্য অপরাধকেও হালাল মনে করা হচ্ছে নিঃসংকোচে।
হয়ত অতীতের সেই সোনালি যুগের সামাজিক সম্প্রীতির সম্যক ধারণা নূতন প্রজন্মের নিকট আজ অজানা, তথাপি সামগ্রিকভাবে দেশের আপামর জনসাধারণ তথা আবালবৃদ্ধবনিতা একটা আগামী সুন্দর সম্প্রীতিময় দিনের প্রত্যাশী। আমরা আবারো সেই সোনাঝড়া অতীতে ফিরে যেতে চাই। বিভাজন নয়, স্নেহ, মমতা, শ্রদ্ধা ভালবাসায় অতীতের মতই সিক্ত হতে চাই পুনর্বার।
তাই পারিবারিক, সামাজিক, সাম্প্রদায়িক ও জাতীয় সম্প্রীতির বড্ড প্রয়োজন আজ।