কিংবদন্তীর বানিয়াচংয়ে কালজয়ী উপাখ্যান আলাল-দুলাল রানি ভবানী আমেনা সুন্দরী আফজাল খান আরজু বানুর স্মৃতি বিজড়িত

প্রাচীন বাংলার প্রতিচ্ছবি বানিয়াচংয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রধান নিদর্শনসমূহ আজও দর্শনার্থীদের জন্য চুম্বকার্ষণ

আতাউর রহমান কানন

সকাল সাড়ে ১১টায় বানিয়াচংয়ে পৌঁছলাম। দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসার এস.এম. আলম আমাকে রিসিভ করে তার অফিসকক্ষে নিয়ে বসিয়ে বললেন, স্যার, আপনি তো যথাসময়ে এসেছেন। কিন্তু এখানের লোকজন তো এখনও এসে পৌঁছেন নাই।
আমি বললাম, অফিসারগণ সব আছেন তো?
-স্যার, তা আছেন।
-ঠিক আছে, তাঁদের নিয়েই শুরু করি। বাকিরা আশা করি ততক্ষণে এসে যাবেন।
ইউএনও আমাকে সভাকক্ষে নিয়ে গেলেন। উপজেলার ১৫ ইউনিয়নের মধ্যে তিনজন চেয়ারম্যান ও কলেজের প্রিন্সিপালসহ কয়েকজন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানও এসে বসেছেন। গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে এখনও তেমন কেউ আসেননি। এরমধ্যেই আমার অনুমতি নিয়ে ইউএনও সভা শুরু করলেন। ‘একনজরে বানিয়াচং’ উপজেলার তথ্যাদি তুলে ধরলেন। এরপর আমি বিভিন্ন অফিসের অফিসারদের বক্তব্য শুনতে থাকি। ধীরে ধীরে অন্যান্য চেয়ারম্যান ও কতিপয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এসে আসন নিলে সভাকক্ষ প্রায় ভরে ওঠে।
বানিয়াচং উপজেলাটি হবিগঞ্জের বৃহত্তম উপজেলা এবং বানিয়াচং নামীয় গ্রামটি এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম নামে অভিহিত। ১৫টি ইউনিয়নসমেত এই উপজেলার আয়তন ৪৮২.৪৬ বর্গকিলোমিটার; যেখানে প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার লোক বাস করে। ১৭৯০ সালে বানিয়াচং প্রশাসনিক থানা হিসেবে গঠিত হয়। এইচ এম এরশাদের প্রশাসনিক পুনর্গঠনের সময় এটি মানোন্নীত হয়ে উপজেলায় পরিণত হয়।
বানিয়াচং হাওড়-বাঁওড়ে সুশোভিত, অসংখ্য নদ-নদী বিধৌত ও খাল-বিল-ঝিল অধ্যুষিত এক নৈসর্গিক নয়নাভিরাম জনপদ। বর্ষায় হাওড়ের থৈ থৈ জলরাশির বুকে দ্বীপের মতো ভেসে থাকা ছোট ছোট গ্রাম, আর বয়ে চলা নানারকম নৌকার অকল্পনীয় এক মনমাতানো দৃশ্য- যা ভাটির দেশের মানুষের মনে মরমী গানের ঢেউ তোলে। কণ্ঠে কণ্ঠে মন-উদাসী ভাটিয়ালি-জারি গান ভেসে বেড়ায় আকাশে বাতাসে। বিস্তীর্ণ বর্ষার হাওড় শুষ্ক মৌসুমে রূপান্তর হয় সবুজ ফসলের মাঠে। এলাকার মানুষ হাওড়ের মাছ আর ধান নিয়েই তাদের বংশ পরম্পরায় সুখী দিনাতিপাত করছে। তাই একবাক্যে বলা হয়- ‘গোলায় ধান, জলায় মাছ ও গলায় গান- এই হলো হাওড়বাসীর জীবনমান’। বানিয়াচং আবহমানকালের লোকসাহিত্য-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। আরি, আন্নি, ঘাটু, কেচ্ছা-কাহিনী, প্রবাদ-প্রবচন, ছিলোক বা ধাঁধাঁ ও পালাগানের মতো প্রাচীন লোকগানেরও সৃষ্টি এ অঞ্চল থেকেই যা গবেষকদের সংগ্রহ থেকে প্রমাণিত। এছাড়া মালজোড়া, বাউল, মারফতি, মুর্শিদী, দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদীসহ জারি, সারি, গীত, ধামাইল ও ভাটিয়ালি গান এতদাঞ্চলের মরমি গায়ক ও সাধক-কবিদের সৃষ্টি। কালজয়ী উপাখ্যান আলাল-দুলাল, রানি ভবানী, আমেনা সুন্দরী, আফজাল খান ও আরজু বানুর স্মৃতি বিজড়িত এই কিংবদন্তীর বানিয়াচং।
একদা পূর্ববাংলার হাওড় বা ভাটি এলাকা নিয়ে ক্ষুদ্ররাজ্য গড়ে উঠেছিল; যার রাজধানী ছিল এই বানিয়াচং। রাজা-জমিদারদের শাসনকাল, বীরত্বগাঁথা ও কীর্তিসমূহ ইতিহাসের পাতায় বিধৃত হয়েছে। সেসবের মধ্যে চারশ থেকে পাঁচশ বছরের প্রাচীন মসজিদ-মন্দির, রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, কৃত্রিম জলাশয় সাগরদিঘি ও বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের আখড়াসমূহ কালেরসাক্ষী হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। প্রাচীন বাংলার প্রতিচ্ছবি এই বানিয়াচংয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারকবাহক প্রধান নিদর্শনসমূহ আজও দর্শনার্থীদের জন্য চুম্বকার্ষণ। জানা-দেখার আগ্রহীগণ ইচ্ছে করলে সেসব দেখে আসতে পারেন বৈ-কি!
১. বিথঙ্গলের আখড়া: বানিয়াচং উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে পৈলারকান্দি ইউনিয়নের বিথঙ্গল গ্রামে হাওড় পাড়ে আখড়াটি অবস্থিত। এটা বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের জন্য অন্যতম তীর্থস্থান। এ আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ গোস্বামী উপমহাদেশের বিভিন্ন তীর্থস্থান সফর শেষে ষোড়শ শতাব্দীতে বিথঙ্গল গ্রামে এসে আখড়াটি প্রতিষ্ঠা করেন। এ আখড়ায় ১২০ জন বৈষ্ণবের জন্য ১২০টি কক্ষ রয়েছে। উল্লেখ্য প্রায় ৫শ বছর পূর্বে ত্রিপুরার রাজা উচ্চবানন্দ মানিক্য বাহাদুর প্রাচীন নির্মাণশৈলী সমৃদ্ধ দুইটি ভবন নির্মাণ করে দেন এবং মানিক্য বাহাদুর ও তাঁর স্ত্রী প্রায়ই ধর্মকর্মের জন্য এই আখড়ায় এসে অবস্থান করতেন। এ ভবনগুলো সংরক্ষণের অভাবে এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বর্তমানে জনৈক ব্যক্তি আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ গোস্বামীর সমাধিস্থলে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর একটি ভবন তৈরি করে দিয়েছেন। এ আখড়াটি ঘিরে কার্তিক মাসের শেষ দিন ভোলা সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে কীর্তন হয়। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দোলপূর্ণিমার পাঁচ দিন পর পঞ্চম দোল উৎসব উদযাপিত হয়। চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে ভেড়ামোহনা নদীর ঘাটে ভক্তগণ পূণ্যস্নান করেন এবং স্নানঘাটে বারুনী মেলা বসে। এ ছাড়া আষাঢ় মাসের ২য় সপ্তাহে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। আখড়ার প্রতিটি উৎসবে কমবেশি ১০ হাজার ভক্তের সমাগম ঘটে। ঐ আখড়ায় দর্শনীয় বস্তুর মধ্যে রয়েছে ২৫ মণ ওজনের শ্বেত পাথরের চৌকি (খাট), পিতলের তৈরি সিংহাসন, প্রাচীন কারুকার্যময় রথ, রৌপ্য পাখি ও সোনার মুকুট।
২. লক্ষীবাওড় জলাবন:
বানিয়াচং উপজেলা সদরের আদর্শ বাজার নৌকাঘাট থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে খরতি নদীর দক্ষিণ দিকে বিরাট হাওড়ের মাঝে এ জলাবন (সোয়াম্প ফরেস্ট)। এটি দেখতে বর্ষাকালে নৌকায়, আর শুকনো মৌসুমে মোটর সাইকেল-ট্রলিসহ হালকা যানবাহনে ও পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়। হাওড়ের মধ্যে অবস্থিত এই জলাবন এলাকাবাসীর নিকট খড়তির জঙ্গল নামেও পরিচিত। কখন এই বন সৃজন হয়েছে কেউ জানেন না। প্রকৃতির এই বিচিত্র সৃষ্টি সত্যিই বিস্ময়কর! বর্ষাকালে দূর থেকে দেখে মনে হয় পানির ওপর ভাসমান বনাঞ্চল। হিজল, করচ, বরুণ, কাকুরা, বউল্লা, চাইল্লা, নলখাগড়া ও অসংখ্য গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ এই জলাবন। এটি সিলেটের গোয়াইনঘাটের বিখ্যাত রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টের সমগোত্রীয় এবং দেশের বৃহৎ জলাবন। বর্ষাকালের কয়েকমাস পানিতে নিমজ্জিত থাকে। বনের ভেতর কয়েকটি খাল ও বিল রয়েছে। ওইসব খালে-বিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। জলাবনটি পাখি ও বন্য প্রানির অভয়ারণ্য। সেখানে বিভিন্ন প্রকার দেশি ও পরিযায়ী পাখপাখালি ছাড়াও রয়েছে সরীসৃপ ও মেছোবাঘ-শিয়ালের মতো স্তন্যপায়ী জীবজন্তু।
৩. শ্যাম বাউলের আখড়া:
শ্যাম বাউল গোস্বামী নামে এক বৈষ্ণব কর্তৃক এ আখড়াটি দীর্ঘকাল পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। বানিয়াচংয়ের সর্বদক্ষিণে যাত্রাপাশার দক্ষিণ প্রান্তে এ আখড়াটি অবস্থিত। শ্যাম বাউল জগন্মোহনী বৈষ্ণব ধর্মানুসারী ছিলেন। লাখাই উপজেলার বাঘাসুরা নিবাসী জগন্মোহনী গোস্বামী প্রায় তিনশত বৎসর পূর্বে এ ধর্মের প্রবর্তন করেন। এ ধর্মমতে গুরুকে প্রত্যক্ষ ভগবান জ্ঞানক্রমে গুরুকেই উপাস্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এরা কোনো মূর্তিপূজা করে না, জাতিভেদে বিশ্বাস করে না এবং তত্ত্বগতভাবে পুরুষদিগের ব্রহ্মচর্য অবশ্য পালনীয়। তবে জগন্মোহিণী সম্প্রদায়ের লোকজন নিজেদেরকে বৈষ্ণব হিসেবে অভিহিত করলেও, বৃন্দাবন কর্তৃক তাদের ধর্মমত বৈষ্ণব ধর্ম হিসাবে বিবেচিত নয়। (চৌধুরী, অচ্যুতচরণ, ২০০৪, পৃ ১৩৪)। স্থানীয়ভাবে এ সম্প্রদায়ের লোকজনকে বৈরাগী বলে আখ্যায়িত করা হয়। কৈবর্ত সমাজে এ ধর্মের প্রচলন সমধিক। শ্যাম বাউলের আখড়ায় নিত্য আধ্যাত্মিক গান-বাজনা কীর্তন অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। প্রতি বৎসরান্তে সেখানে বারুনী উপলক্ষ্যে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বহুলোক সমাগম হয়। জনশ্রুতি আছে, শ্যাম বাউলের আখড়ার বারুনী উপলক্ষ্যে অপরাহ্ণে অতি-অবশ্য ঝড়-তুফান হয়ে থাকে।
৪. সাগরদিঘি:
রাজা পদ্মনাভ দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রজাদের জলকষ্ট নিবারণের জন্য তৎকালীন বানিয়াচং গ্রামের মধ্যভাগে ‘সাগরদিঘি’ নামক এক বিশাল জলাশয় খনন করেন। এ দিঘি খননের পর পানি না উঠায় স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে রাজা পদ্মনাভের স্ত্রী রাণী কমলাবতী আত্মবিসর্জন দেন বলে একটি উপাখ্যান এ অঞ্চলে প্রচলিত আছে। এ জন্য এ দিঘিকে কমলা রানির দিঘিও বলা হয়ে থাকে। এ দিঘি নিয়ে বাংলা সিনেমাসহ রেডিয়ো-মঞ্চ নাটক রচিত হয়েছে। এ দিঘির পাড়ে বসে পল্লী কবি জসিম উদ্দিন ‘রাণী কমলাবতীর দিঘী’ নামে একটি কবিতা রচনা করেছিলেন। সে কবিতাটি তাঁর ‘সূচয়নী’ কাব্য গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ দিঘিটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বলে খ্যাতি রয়েছে। বানিয়াচংয়ের অধিবাসী তৎকালীন মৎস্য ও পশুপালন মন্ত্রী সিরাজুল হোসেন খান ১৯৮৬ সালে দিঘিটি পুনঃখনন করান। বর্তমানে এর চার পাড়সহ ৬৬ একর জায়গা নিয়ে দিঘিটি বিস্তৃত।
৫. রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ:
গোবিন্দ সিংহ বানিয়াচং রাজ্যের অধিপতি হওয়ার পর পদ্মনাভ বা কর্ণখাঁর দিঘির পশ্চিম পাড়ে রাজবাড়ি গড়ে তোলেন। বর্তমানে ঐ রাজবাড়ির কিয়দংশ বিদ্যমান আছে। পাশে ধর্মান্তরিত গোবিন্দ সিংহ তথা হবীব খাঁ’র (প্রাচীন ইটে মোড়ানো) সমাধি রয়েছে। রাজবাড়ীর বাকি প্রাচীন ইট সরিয়ে প্রায় একশ বছর পূর্বে লোকনাথ রমন বিহারী উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। এ রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ নিয়ে একটি কল্পকাহিনি এ অঞ্চলে প্রচলিত আছে। ধ্বংসাবশেষের মধ্যে পাথরের দালানের ৪টি পিলার দন্ডায়মান রয়েছে এবং এর চারপাশে খন্ডবিখন্ড বেলে ও মার্বেল পাথরের অংশ পড়ে আছে। ওইগুলোকে ‘হব্যা’ ও ‘ঘোমা’ দাবাগুটি বলা হয়ে থাকে। কল্পকাহিনিতে হব্যা ও ঘোমা দুই ভাই পালোয়ান ছিলেন। তাঁরা দিঘির পাড়ে এ পাথরের খন্ড নিয়ে দাবাগুটি খেলতো বলে জনশ্রুতি রয়েছে। নির্ভরযোগ্য অনেকেই বলেন, আসলে হব্যা ও ঘোমা একই নাম। হবীব থেকে ‘হব্যা’ এবং গোবিন্দ থেকে ‘ঘোমা’ নামে অপভ্রংশে প্রচার পায়। প্রায় সপ্তদশ শতাব্দীতে দেওয়ান আবেদ রাজা ঐ রাজবাড়ি বানিয়াচং কসবার উত্তরাংশে স্থানান্তর করেন। ওই এলাকা দেওয়ানবাগ হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে ঐ রাজবাড়ির জরাজীর্ণ প্রাচীন দালান ও প্রাচীর বিদ্যমান এবং সম্পূর্ণ মোগল স্থাপত্যে তৈরি একটি দর্শনীয় স্থান। (চলবে…)