এসএম সুরুজ আলী ॥ পবিত্র ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে কোরবানীর গরুর মাংস কাটার উপকরণ তৈরি নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন হবিগঞ্জের কর্মকাররা। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত লোহার নানা জিনিস তৈরির টুং টাং শব্দে মুখর হয়ে উঠেছে জেলার কামার পট্টি বা কর্মকার পট্টি এলাকা। বিশেষ করে হবিগঞ্জ শহরের কামার পট্টি এলাকায় প্রতি বছর কর্মকাররা ঈদুল আযহার কোরবানীর গরুর মাংস কাটার দা, বটি, টাকুয়াল, ছুরিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরীতে ব্যস্থ সময় পার করেন। আবার কেউ পুরনো দা, বটি, ছুরি নতুন করে ধার বা শান দেয়ার জন্য ভিড় জমাচ্ছে কামারদের দোকানে। লোহা জাতীয় জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে অন্যান্য বছরের চেয়ে এসব সরঞ্জামাদির দাম এবার অনেকটাই বেশি। অপর দিকে কামাররা জানান, বিভিন্ন কোম্পানী তাদের তৈরী জিনিসগুলো তৈরী করায় আগের তুলনায় তাদের কাজ অনেকটা কমে গেছে। এ কারণে কামার শিল্প দিন দিন বিলুপ্ত হওয়ার পথে বসেছে। কামারের সন্তানেরা আর এ পেশায় নিজেদের যুক্ত করতে চান না বলে তারা জানিয়েছেন। বুধবার হবিগঞ্জ শহরের কামার পট্টি ও বানিয়াচং নতুন বাজারের কামারদের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, তারা মাংস কাটার সামগ্রী দা, ছুরি, চাকু, টাকুয়ালসহ অন্যান্য জিনিস তৈরীতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। দোকানগুলোতে নতুন দা, চাকু, ছুরি বানানোর জন্য প্রচুর ভীড়। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য তৈরীতে ব্যস্ত কামাররা। এ ব্যস্ততা ঈদের আগ রাত পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছেন তারা। অপরদিকে ক্রেতারা জানিয়েছেন কোরবানীর মাংস কাটার জন্য তৈরী সামগ্রীর দাম অনেকটা বেড়েছে। বানিয়াচঙ্গের কামার কালি পদ দেব জানান, লোহার দাম আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণে এর সাথে মিল রেখে আমাদের দা, ছুরিসহ অন্যান জিনিস বিক্রি করতে হচ্ছে।
কর্মকার কৃষ্ণ পদ দেব জানান, এখন আর আগের মত কামারদের কাজ নেই। চায়নার বিভিন্ন কোম্পানী আমাদের তৈরী অনেক জিনিস তৈরী করে বাজারে বিক্রি করছে। এখন হার্ডওয়্যারের দোকানে গেলে অনেক জিনিস পাওয়া যায়। যে কারণে ক্রেতারা আমাদের কামারের দোকানগুলোতে কম আসছেন। তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের সন্তানেরা আর এ পেশার আসতে চায় না। তাই কামার শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বিদেশী পণ্য বাজারজাত বন্ধ করতে হবে।
শহরের কামার পট্টির ব্যবসায়ী মানিক মিয়া জানান, সারা বছর আমাদের তেমন কোন কাজ থাকে না। পবিত্র ঈদুল আযহা আসলে আমাদের হাতে অনেকটা কাজ বেড়ে যায়। তবে চায়নার তৈরী জিনিস বাজারে আসার কারণে আমাদের হাতের তৈরী জিনিস অনেকটা কম বিক্রি হচ্ছে। এ অবস্থায় আমাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আমাদের নতুন প্রজন্ম এ পেশায় আসতে চাইবে না।
কামার পট্টির ব্যবসায়ী নয়ন কর্মকার জানান, সারা বছর আমাদের বেচাকেনা খুবই কম হয়। ঈদুল আযহার সময় একটু বেশি বেচাকেনা হয়ে থাকে।
শিক্ষক আব্দুল জব্বার জানান, প্রতি বছর কোরবানীর ঈদের মাংস কাটার জন্য দা, বটি, ছুরি ক্রয় করতে কামার পট্টিতে আসি। এবার বাজারে এসে দা, বটি ও ছুরি ক্রয় করেছি। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার দাম একটু বেশিই। এবার বাজারে নতুন ছোট দা ১শ’ থেকে শুরু করে সাইজ অনুযায়ী সাড়ে তিনশ, ৪শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি দা সাড়ে ৪শ’ থেকে সাড়ে ৬শ’, ৭শ’, ৮শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। টাকুয়াল ৫শ’ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বড় সাইজের ছুরি সাড়ে ৩শ’ টাকা থেকে ৫শ’ টাকা, বিভিন্ন সাইজের চাকু একশ টাকা থেকে ৩শ’ টাকা, বটি ৫শ’ টাকা থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
জেলার বিভিন্ন স্থানের কর্মকারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সাধারণত স্প্রিং লোহা ও কাঁচা লোহা ব্যবহার করে দা-বঁটি ও ছুরি তৈরি করা হয়। স্প্রিং লোহা দিয়ে তৈরি উপকরণের মান ভালো, তাই দামও একটু বেশি। এছাড়া আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে আমাদের দেশে বর্তমানে কৃষি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে বিদেশ থেকে আমদানি করা উন্নত মানের আধুনিক যন্ত্রপাতি। যার ফলে সনাতন পদ্ধতির যন্ত্রপাতি ব্যবহারে কৃষকদের তেমন আগ্রহ নেই। ফলে সারা বছর জেলার কামাররা হাত গুটিয়ে বসে থাকেন কোন কাজ না থাকায়। এখন প্রতি বছর কোরবানীর ঈদ এলেই বিভিন্ন উপকরণ তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা।
চায়নার বিভিন্ন কোম্পানী অনেক জিনিস তৈরী করে বাজারে বিক্রি করছে, ফলে দিন দিন বেকার হয়ে পড়ছেন কর্মকাররা
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com