জালাল আহমেদ
সেই বাসায় সাপের ভয়ও ছিল প্রবল

অর্পিত সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা সারাদেশের মত নোয়াখালীতেও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এর জন্য একটি সমস্যা সংকুল বিষয় ছিল। আমরা সবাই জানি যে ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ দেশ ত্যাগ করে ভারতে যায়। পাকিস্তান সরকার এই সকল দেশত্যাগী মানুষের পরিত্যাক্ত সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি আখ্যা দিয়ে আইন পাস করে ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত দেশত্যাগীদের সম্পত্তি সরকারি হেফাজতে নিয়ে আসে। মহকুমা প্রশাসকরা নিজ নিজ মহকুমায় এ ধরণের তালিকা করে তা অনুমোদন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এই সম্পত্তির দায়িত্ব সরকারের উপর অর্পিত হয়েছে বলে তাকে অর্পিত সম্পত্তি বলা হয়। ১৯৮৮ সালে মোকাম্মেল হক যখন ভূমি সচিব তখন কোন এক অজ্ঞাত কারণে তিনি এই তালিকা হালনাগাদ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই হালনাগাদ তালিকা সারাদেশেই একাধিক সমস্যার সৃষ্টি করে। প্রায় সারাদেশেই খতিয়ানের শুরুর নাম হিন্দু বা কখনো একটি নাম হিন্দু দেখে পুরো খতিয়ানকেই অর্পিত সম্পত্তি তালিকাভুক্ত করা হয়।
জানুয়ারি ১৯৮৮ সালে নোয়াখালীতে অর্পিত সম্পত্তি ছিল ৪ হাজার একর, জুলাই ১৯৮৮ তে এই পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ হাজার একর যার প্রকৃত অর্থে কোন ভিত্তি নেই। নতুন যে তালিকা করা হয় তা টাইপকৃত এবং কর্মকর্তাদের ফ্যাক্সিমিল স্বাক্ষর যুক্ত। আর মূল তালিকা হাতে লেখা এবং মহকুমা প্রশাসক স্বয়ং তা সই করে অনুমোদন করেছিলেন। ফলে দেওয়ানী আদালতে অর্পিত সম্পত্তি সংক্রান্ত যে কোন মামলায় সরকার হারতে শুরু করে। আদালতসমূহ ফ্যাক্সিমিল স্বাক্ষর যুক্ত তালিকাকে নির্ভরযোগ্য হিসাবে গ্রহন করতেন না। পুরো নোয়াখালী জেলায় খুঁজে মাত্র একটি তহশীলে মূল তালিকা খুঁজে পাই। আবার ৬ হাজার একর বাড়তি জমি সমস্যারও সৃষ্টি করে। এসকল জমি সরকারি দখলে বা ব্যবস্থাপনায় ছিল না। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর পৈত্রিক জমিও ঐ তালিকায় ছিল। নোয়াখালীর শিল্পপতি আনওয়ার মীর্জা’র ১৯৭০ সালে ক্রয় করা, ১৯৭১ এ মিউটেশন করা একটি জমিও সে তালিকায় ছিল।
নোয়াখালীর কুখ্যাতি ছিল ১৯৪৬ এর দাঙ্গার জন্য এবং মহাত্মা গান্ধী ঐ দাঙ্গা পরবর্তী সময়ে নোয়াখালী আসেন এবং কিছুদিন অবস্থান করেন। তখন তিনি চাটখিলে ব্যারিস্টার হেমন্ত কুমার ঘোষের বাড়িতে অবস্থান করেন। পরবর্তীতে ব্যারিস্টার সাহেব তাঁর ঐ বাড়ি ট্রাস্ট ডিড করে আম্বিকা-কালিগংগা চ্যারিটেবল ট্রাস্ট গঠন করেন এবং তাঁর সকল সম্পত্তি ট্রাস্টে দিয়ে দেন। ১৯৭৫ সালে এটি গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টে রূপান্তরিত হয়। এর আদর্শ উদ্দেশ্যও তখন পরিবর্তিত হয় এবং সমাজ উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কাজে এই ট্রাস্ট ব্যাপৃত হয়। আমি নোয়াখালী থাকার সময় ঝর্ণাধারা চৌধুরী এই আশ্রম পরিচালনা করতেন। ট্রাস্টকৃত সম্পত্তি ও এর সীমানা নিয়ে বেশ কিছু বিরোধ ছিল। এ সব কারণে আমি একাধিকবার এই আশ্রমে গিয়েছি। পরবর্তীতে ঝর্ণাধারা চৌধুরী বাংলাদেশে একুশে পদক ও ভারতে পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রাপ্ত হন। আশ্রম থেকে আশেপাশের এলাকায় বেশ কিছু সমাজ উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হত।
নোয়াখালী সদর উপজেলার অন্যতম বড় ইউনিয়ন ছিল লক্ষ্মীপুর জেলার সীমান্তবর্তী চরমটুয়া। চরমটুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন জাফর আহমেদ চৌধুরী। তিনি স্থানীয় একটি অভিজাত পরিবারের সন্তান। ১৯৭৭ ব্যাচের প্রাক্তন সচিব ইকবাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ছিলেন একই পরিবারের। এই পরিবারেরই পূর্ব পুরুষ পানা মিয়া তাঁর বিপুল সম্পত্তি একটি ট্রাস্ট ডিড করে ট্রাস্ট করে যান। এই সম্পত্তির বিপুল অংশ মেঘনার ভাংগনে ভেঙ্গে যায় কিন্তু যখন চর জাগে তখন ট্রাস্ট আর এ সব সম্পত্তির দখল ফিরে পায় নাই। তবে বলা হত যে হাজী মুহম্মদ মুহসীন ফান্ডের পর পূর্ববঙ্গে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় ট্রাস্ট। ট্রাস্টের প্রশাসক ছিলাম আমি এবং ট্রাস্ট একটি হাই স্কুল পরিচালনা করতো, তার সভাপতিও ছিলাম আমি। ফলে মাঝে মাঝেই চরমটুয়া পানা মিয়া হাইস্কুলে গিয়েছি। অক্টোবর ২০১৯ এ যখন নোয়াখালী বেড়াতে যাই তখন জাফর চেয়ারম্যানের সংগে দেখা হয়।
আমার সোনাপুরের বাংলো আমি বলেছিলাম বিশাল আকারের এবং দিঘীর চার পাড়ের বাসিন্দাদের বিষয়েও একটা ধারনা দিয়েছিলাম। এই দিঘীর মাঝখানে একটা গোল আকারের কূয়া ছিল বলে পুরোনো লোকজন বলেছেন, সম্ভবতঃ পানির তল মেইন্টেইন করার জন্য। বাংলোটি প্রায় দশ বিঘা জমির আংগিনার কিছুটা সামনের দিক ঘেঁষে, ১১৮ ফিট লম্বা। সামনে টানা বারান্দা আর চারটি বড় ও দুটি ছোট বসবাসের রুম ছিল। পেছনের অংশে একাধিক স্টোর, বাথরুম ও রান্নাঘর ছিল। মূল রান্নাঘর পেছনে আলাদা ভিটির উপরে, তার ভিত্তি আমরা পেয়েছি কিন্তু ঘরটি তখন ছিল না। বাংলোর ভেতরের আংগিনা’র এককোনে একটি ছোট পুকুর ছিল যাতে কখনো কখনো ছোট মাছের বড়শি দিয়ে মাছ ধরেছি। বাসায় বিভিন্ন ধরণের গাছ গাছালি ছিল। গেটের পাশেই ছিল বিশাল দুটি রেইন ট্রি। কিছুটা অপ্রচলিত গাছের মধ্যে ছিল ডেওয়া গাছ, বিলাতি গাব ও নাটা ফলের গাছ।
বাসার গাছগাছালি গ্রামীণ কুঞ্জ বনের সম্প্রসারণ হওয়ায় বিভিন্ন বুনো প্রাণীর আনাগোনা ছিল। একত্রে বসবাস ছিল অন্ততঃ ২০টি কালোগুই ও সোনাগুই এর পরিবার। কালোগুইগুলো ছিল প্রমাণ সাইজের চেয়েও বড়। কখনো তারা বারান্দার উপর দিয়ে ক্রস করতো। একবার তো বাসার ভেতর দিয়েই এপাড় ওপাড় করলো। এছাড়াও ছিল বাগডাশ এবং গন্ধগোকুল। তাদের আস্তানা এবং বংশবৃদ্ধির ব্যাপার স্যাপারও ছিল কখনো কখনো সিলিং এর উপর। বাসার বেডরুম ছিল এক কর্নারের দিকে, তার সিলিং ছিল প্রায় ৪৫% ঢালু। একবার এক বাগডাশের বাচ্চা এই ঢালুতে পড়ে গিয়েছিল। তাকে উদ্ধার করতে তার মায়ের কয়েকদিন লেগে যায়। ফলে মাও সেখানে যাতায়াত করতে থাকে এবং একদিন প্র¯্রাব করে আমার ছোট ছেলে অক্ষর এর উপর। সাপের ভয়ও ছিল প্রবল।
আমার আগের অকুপ্যান্ট একেএম মাহবুবুল আলম থাকাকালীন বুক শেলফের বইয়ের উপর সাপ বসে ছিল। ফলে বাসা জুড়ে রাখা ছিল কার্বলিক এসিড। আমার ছোট ছেলে অক্ষর একদিন এসিডের এক বোতল তার হাতের উপর খালি করলো, ভাগ্যিস মুখে ঢালেনি। এই বাসায় কেটেছে তার জীবনের প্রথম তিন বছর। বাসার বারান্দায় কেউ উঠলেই বেডরুমের দরজায় বা জানালায় হাত রাখতে পারতো, নিরাপত্তা বলতে কিছুই ছিল না। তখন বারান্দার অর্ধেক ডায়মন্ড জি আই নেট দিয়ে সুরক্ষিত করা হয়। সেই ধারালো নেটে অক্ষরের হাতের এক আংগুলের এক টুকরো মাংস চলে যায়। আমি তার আংগুল নিয়ে চিন্তিতই ছিলাম তবে বয়সের সংগে সংগে তা মিলিয়ে গিয়েছে। বাসার জমিতে একটি চাষী পরিবার বিভিন্ন রকম সব্জীর চাষ করতো। দিঘীর চারপাড়ে আমাদের বাসাগুলোর পেছনেই ছিল পেশাদার লোকজনের বসবাস। নাপিত ধোপাসহ এমন বিভিন্ন পেশার লোকদের বসানোই হয়েছিল সাহেবপাড়া’র লোকদের সেবার জন্য। পশ্চিম পাশে বেশ কিছু ঘরে খৃস্টান পরিবার বসবাস করতো এবং সুন্দর কম্পাউন্ড বিশিষ্ট একটি বালিকা বিদ্যালয়ও ছিল সেখানে।
একদিন সম্ভবতঃ বন্ধের দিনে আমি বাসায়, দেখলাম এক ভদ্রলোক আগেকার দিনের বড় সাইজের ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে দিঘীর পাড়ের ছবি তোলার পর বাসার আঙ্গিনায় ঢুকে বাসার ছবি তুলছে। জিজ্ঞেস করলাম যে কোত্থেকে আসছেন? বললেন যে তিনি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, এই বাংলোতে তার জন্ম ১৯৫৫ সালে। ৪১ বছর পর এসেছেন জন্মস্থানের ছবি তুলে নিয়ে যেতে মায়ের জন্য। পানা উল্লাহ আহমদ ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৫ নোয়াখালীর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর ছিলেন। তিনি মেয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন রামগতির এক পরিবারে। তার মেয়ের প্রথম সন্তানের জন্ম হয় এই কালেক্টর’স বাংলোতে। সেই ছেলেই এসেছে ছবি তুলে নিয়ে যেতে বৃদ্ধা মায়ের স্মৃতিময় বাংলোর!