আবুল কালাম আজাদ, চুনারুঘাট থেকে ॥ একটি মান্দার গাছকে ঘিরেই এখন সাতছড়িতে শত শত ফটোগ্রাফারের মেলা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ মান্দার গাছেই তাক করে আছে লাখো টাকার ক্যামেরার ল্যান্স। বলা চলে এ মান্দার গাছ দিয়েই এখন তারা বিশ্বে নতুন পরিচিতি লাভ করছেন। ইতোমধ্যে এ মান্দার গাছে পাখির ছবি দিয়ে আন্তর্জাতিক একাধিক পুরস্কার লাভ করেছেন তারা। তাই এবারও তারা এ সুযোগ হাতছাড়া না করতেই গত এক মাস ধরেই হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ওয়াচ টাওয়ারের পাশের এই মান্দার গাছটি দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছুটে আসেন অনেকেই। এ গাছকে ঘিরে পর্যটকদের পাশাপাশি শতাধিক ফটোগ্রাফার সেখানে দিন কাটাচ্ছেন।
মান্দার বা পারিজাত যে নামেই গাছটিকে লোকে চিনে থাক, এর লাল ভুবন ভোলানো ফুল যে কারওই নজর কাড়ে। দেশে অনেক প্রজাতির প্রচুর গাছ থাকলেও হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের একটি মান্দার গাছ সম্প্রতি দেশে-বিদেশে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। বলা চলে এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই মান্দার গাছটি।
সাতছড়ির এই জাতীয় উদ্যানে গাছের সংখ্যা কম না হলেও এই মান্দার গাছটিই প্রকৃতিপ্রেমী এবং আলোকচিত্রীদের কাছে সবচেয়ে আকাক্সক্ষার এবং পরিচিত। এই গাছের ছবি উইকিলিকসসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ডও জয় করে নিয়েছে। বসন্তের দিনে এই গাছটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকার জায়গা পাওয়াও কঠিন। বাংলাদেশের আর কোথাও বা কোন বনে একটি গাছের সামনে এত ভিড় বা একটি গাছের পরিচিতি সারা বিশ্বে এভাবে ছড়িয়ে পড়ার খবর জানা যায় না।
মান্দার গাছটি দেখতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন ছুটে ছুটে আসছেন পর্যটক, প্রকৃতিপ্রেমী ও আলোকচিত্রীরা। তাদের অনেকে আবার তাঁবু খাঁটিয়ে রাত কাটিয়ে দিচ্ছেন এই গাছের পাশেই ।
জনপ্রিয় এই মান্দার গাছ নিয়ে সাতছড়ি বিট কর্মকর্তা মাহমুদ হোসেন বলেন, সাতছড়ির এই মান্দার গাছে যেন পুরো একটি বনের পরিচয়! প্রকৃতিপ্রেমিক কিংবা পর্যটক সবাই এখন এই গাছটিকে চেনেন। বসন্তে কত মানুষ যে এর ছবি তুলতে যান তা বলে শেষ করা যাবে না। বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন আলোকচিত্রী বিশ্বখ্যাত অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন এর ছবি তুলে। এই গাছটিকে উপভোগ করতে হলে একটি টাওয়ারে উঠতে হয়। ছুটির দিনগুলোতে এই টাওয়ারে জায়গা পাওয়া মুশকিল। আমাদের দেশে একটি বনের সৌন্দর্য দেখতে আর কোথাও এত মানুষের ভিড় আছে কিনা সন্দেহ!
মান্দার গাছটি শুধু মানুষের কাছেই জনপ্রিয় নয়। পশুপাখির কাছেও সমান প্রিয়। প্রায় ৪০ জাতের পাখি ঘুরে ফিরে এই গাছে দেখা যায়। বেশির ভাগই পোকা খেকো। কিছু কিছু মধু খেকো। পতঙ্গদেরও প্রিয় জায়গা এই গাছের ফুল। দেখা মিলে কাঠবিড়ালি, গিরগিটি ইত্যাদি।
এই মান্দার গাছের ওপর বসা কাঠশালিকের ছবি তুলে উইকিলিকস অ্যাওয়ার্ড জয় করেছেন বগুড়ার আলোকচিত্রী তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব। তিনি জানান, যারা বার্ডিং (পাখির ছবি তোলা) পছন্দ করেন তাদের জন্য সাতছড়ি একটি স্বর্গ। হবিগঞ্জের আরেক সৌখিন ফটোগাফার সাহেদ আহমেদ এ গাছে জোড়া শালিকের আলিঙ্গনের ছবি তুলে লাভ করেন আন্তর্জাতিক পুরস্কার। যা রীতিমতো অবাক করার মতো। ওয়াচ টাওয়ারের সামনে থাকা মান্দার গাছটি সারা দেশের সব বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী পর্যটকসহ দেশ-বিদেশে পরিচিত। বসন্তে এই গাছের কাঠ শালিকের ছবি অনেক আন্তর্জাতিক বিখ্যাত বিখ্যাত অ্যাওয়ার্ড জয় করেছে। বসন্তে এখানে এক বা একাধিকবার যেতেই হয়। প্রচুর ভিড় থাকে ফটোগ্রাফারসহ পর্যটকদের। পছন্দমতো ছবি তোলার জন্য জায়গা পাওয়াই কঠিন। ফটোগ্রাফারদের কারণে পর্যটকরা এখন ওয়াচ টাওয়ারে যেতে না পেরে অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করছেন।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের তথ্য অনুযায়ী, যে কোনো বনে প্রতি এক কিলোমিটারের ভেতর সাধারণত ৫০ প্রজাতির বেশি পাখি বসবাস করে। কিন্তু সাতছড়ি একমাত্র বন যেখানে এক কিলোমিটারের ভেতর প্রায় ২০০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। অনেক বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির পাখিও পাওয়া যায় এখানে। তাই দেশের পাখিপ্রেমী ও ফটোগ্রাফারদের কাছেও এই বন রয়েছে পছন্দের তালিকায় একেবারে শীর্ষে।
এখানে রয়েছে বিরল লালমাথা-কুচকুচি পাখি। আছে শ্যামা ঘুঘু, হরিয়াল, সবুজ-ধুমকল, পাপিয়া, হুতোম-প্যাঁচা, নীলদাড়ি-সুইচোরা, সুমচাসহ নানা জাতের বিপন্ন, বিরল এবং মহাবিপন্ন পাখি, যা সুন্দরবন ছাড়া দেশের অনেক বনেই নেই। ময়না-টিয়ার দেখা এখানে খুব সহজেই পাওয়া যায়।
এই বছর করোনার কারণে মানুষের উপস্থিতি কম থাকায় সাতছড়ি বনে পাখিরা নিজেদের মতো প্রজনন করতে পারছে। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রতি বছর পাখির প্রজনন মৌসুমে মানুষের যাতায়াত বন্ধ রাখা যেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা পাখিবিদ ড. ইনাম আল হক এ বিষয়ে বলেন, এক কিলোমিটার বনে ৫০ প্রজাতির জায়গায় সাতছড়িতে ২০০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। এটা মোটেও ভালো খবর নয়। এত বড় দেশ আমাদের, কিন্তু পাখিদের বসবাসের ভালো জায়গা না থাকায় সেগুলো এখানে থেকে যায়।
তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে বনটি আমার কাছে খুবই প্রিয়। কারণ এখানে এত বৈচিত্র্যপূর্ণ গাছ এবং লতাপাতা আছে সেই সঙ্গে আছে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ। যা এই বনকে সমৃদ্ধ করেছে। ছোট একটি বনে দুইশ প্রজাতির পাখি তখনই থাকবে যখন তাদের জন্য আলাদা আলাদা খাবার পাওয়া যাবে। এটা একটা ভালো দিক। আমি প্রায় শতবার এই বনে গিয়েছি।