জালাল আহমেদ

আমার পছন্দের দুইজন অতিথি আসছেন কিন্তু আয়োজকরা আমাকে দাওয়াত করেননি ॥ অনাহুত আমি অনুষ্ঠানে গিয়ে দর্শক সারিতে বসে গেলাম

আমার স্ত্রী দ্রুত বাঁশখালীতে তাঁর নতুন জীবনের সাথে মানিয়ে নিলেন। এখানকার কর্মকর্তা ও তাঁদের স্ত্রী’রাও আন্তরিক ছিলেন। বিশেষ করে উপজেলা প্রকৌশলী রেজাউল করিম ও উপজেলা কৃষি অফিসার আবু তাহেরের পরিবার খুব সহযোগী ছিলেন। মনে পড়ে শেখ মরতুজ আলি মিয়া’র স্ত্রীর কথাও। তিনিও আনোয়ারা’র এক অভিজাত পরিবারের সন্তান এবং রুচিবান মহিলা ছিলেন। আমার আম্মা তখন বেশ কিছুদিন আমাদের সংগে ছিলেন। আম্মার সংগে ছিল আমার ভাগনি ছোট্ট ওভভধঃ ঔবনরহ নিতু। বাসায় ছিল খরগোশ, কবুতরসহ কিছু পোষা প্রাণী। বাসার সামনেই ছিল উপজেলা পরিষদের বড় পুকুর, তাতে শান বাঁধানো ঘাট। সেখানে বসতো আমাদের বৈকালিক আড্ডা। আমার রুটিনেও স্বভাবতই একটু পরিবর্তন এলো। আগে অনায়াসে দূরে কোথাও চলে যেতাম আর এখন দুপুরের খাবার যেন বাসায় খেতে পারি সেভাবে ট্যুর ও ভিজিট প্লান করি। বাসায় সহযোগী ছিল এক মহিলা, সখিনা, তার ছেলে মুন্সী ভিক্টরের জন্মের সময় আমার ঢাকার বাসায়ও ছিল। ওহাব মিয়া ছিল বাসার বুড়ো নৈশ প্রহরী, তার দুই ছেলেও উপজেলা পরিষদে কাজ করতো। সব মিলিয়ে এক জমজমাট পরিবেশ।
আমার শ্বশুর শাশুড়িও বেশ কিছুদিন ছিলেন আমাদের সংগে। আমার শ্বশুরের ছিল মাছ ধরার শখ আর গুনাগরি ঋষিধামে পাহাড়ের ভেতর ছিল চমৎকার এক জলাশয়। চারিদিকে পাহাড়ঘেরা এই জলাশয়ে বড় বড় মাছ ছিল। ধামের বাসিন্দারা কেউ মাছ খেতেন না, ধরতেনও না। আমি প্রস্তাব করাতে তাঁরা সানন্দে সম্মতি দিলেন এবং আমার শ্বশুর ওই জলাশয় থেকে ৮/১০ কেজি মৃগেল ধরলেন বড়শিতে। পরে আমার গোচরে এল যে এতে কেউ কেউ একটু ক্ষুন্ন হয়েছিলেন কিন্তু আমাকে কিছু জানাননি। বৈলছড়িতে গ্রামের ভেতরে একটা বড় পুকুরেও সারাদিন মাছ ধরলেন তিনি, সংসদ সদস্য মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী’র বড় ভাই অলিউল ইসলাম সুক্কু মিয়া সারাদিন কাটালেন আমার শ্বশুরের সংগে, অভিজাত পরিবারসুলভ অপার সৌজন্যের প্রকাশ। দুপুরে টেবিল ভর্তি মধ্যাহ্ন ভোজন, যথার্থ অর্থেই ভোজন ছিল সংসদ সদস্যের বাড়িতে।
বাঁশখালী উপজেলায় কালীপুর একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম, একই নামে একটি ইউনিয়নও আছে। কালীপুর এজহারুল হক উচ্চবিদ্যালয় উপজেলার একটি ভালো মাধ্যমিক স্কুল। রাস্তার পশ্চিম পাশে একটি খেলার মাঠও আছে, তারপর স্কুল। আর রাস্তার পূর্বপাশে রাজকুমারী নাসেরা খাতুন বালিকা বিদ্যালয় ও সাব রেজিস্ট্রি অফিস। কালীপুরের লিচুও ছিল বিখ্যাত এবং চট্টগ্রামের বাজারে মৌসুমের শুরুতেই কালীপুরের লিচু উঠতো। কালীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন একজন নিপাট ভদ্রলোক, মফজল আহমদ চৌধুরী। প্রাক্তন চেয়ারম্যান জাকের আহমদ চৌধুরীর বাড়ি ছিল স্কুলের কাছেই। কালীপুর বিখ্যাত বাঁশখালীর কৃতি সন্তান শাহ বদিউল আলমের জন্য। যার জন্ম তাঁর নানার বাসায়, চট্টগ্রামের ডিসি হিলে। হ্যাঁ, চট্টগ্রামের ডিসি হিল এবং বাংলো’র মালিক ছিলেন শাহ বদিউল আলম এর নানা সরকারি উকিল বা পাবলিক প্রসিকিউটর মুনশী জাফর আলী।
শাহ বদিউল আলম নানার বাসভবনের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেন “চট্টগ্রাম শহরে এনায়েতবাজার মহল্লায়, উঁচু উঁচু, সারি সারি, ঝাউ গাছওয়ালা, প্রসিদ্ধ জাফর আলী মুনশীর পাহারস্থ কুঠি সেই স্থানে পথের উত্তর ধারে, কিছু নিম্নভাগে একটি পাকা বাঁধা নির্ঝরিণী আছে, তাঁর নাম শীতল ঝর্ণা”। শাহ বদিউল আলমের বাবা আনওয়ার আলী ছিলেন “মহাপুরুষ, আলেম, ফাজেল, হাজী, দরবেশ, ছদর আলা (সাবজজ) খাঁ বাহাদুর অকৃত্রিম দাতা, দয়ার সাগর, গরীবের মা-বাপ” আর শাহ বদিউল আলম নিজেও ছিলেন আলেম, সুফী, লেখক, সাংবাদিক, সম্পাদক এবং সরকারি কর্মকর্তা। সেই নানার বাড়ি কিভাবে ডিসি হিল হল এই প্রশ্ন আসতে পারে।
১৯১৮-২১ সাল বাংলাদেশের জন্য এক অগ্নিগর্ভ সময়। একদিকে স্বদেশী আন্দোলন নিয়েছে স্বশস্ত্র রূপ আবার অন্যদিকে চলছে খেলাফত আন্দোলন। ঐ সময়কালে কুমিল্লা জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপার দুজনেই স্বদেশীদের হাতে নিহত হন। চট্টগ্রামের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাসভবন ছিল কোর্ট বিল্ডিং তথা পরীর পাহাড়ের পেছনের পাহাড়ে (জহুর মার্কেট এর অপর পাশে, এখন যেখানে ওয়াসার পানির ট্যাঙ্ক)। পরীর পাহাড় থেকে একটি কাঠের সেতুতে তৎকালীন ডিএম হিলে যাওয়া যেত। এখন জলসা সিনেমা’র দিক থেকে জহুর মার্কেটে ঢুকতে, কোর্ট বিল্ডিং এ উঠার সিঁড়ির পাশে সেই সরু জায়গা যেখানে কাঠের সেতুটি ছিল। ১৯৮৩ সালেও আমি কোর্ট বিল্ডিং অংশে সেই সেতুর ভিত্তি দেখেছি।
১৯২১ সালে চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর নিজ বাসভবনে ছুরিকাহত হয়ে নিহত হন। পরবর্তী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এই অভিশপ্ত বাংলোতে উঠতে অসম্মত হন। তখন জাফর আলী মুনশী’র এনায়েত বাজার মহল্লার সেই পাহাড়স্থ কুঠি প্রথমে রিকুইজিশন করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এর বাসভবনে রূপান্তর করা হয়, পরে তা একুইজিশন করা হয়। পূর্ববর্তী ডিএম বাংলোতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা এডিএম বসবাস করতে থাকেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পদবি ১৯৬১ সালে ডেপুটি কমিশনার বা জেলা প্রশাসক করা হলে পাহাড়টি ডিসি হিল নামে পরিচিত হয়।
সেই কালীপুর ইজ্জতনগর খেলার মাঠে নিয়মিত ক্রিকেট খেলা হয়। চাঁদপুরেও ক্রিকেট খেলেছি তাই ভাবলাম এখানেও খেলে দেখা যাক। ইতোমধ্যে খেলাধুলার ক্ষেত্রে আগ্রহের জন্য আমি পরিচিত। কলেজে পড়া কালে কলেজ ক্রিকেট দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেছি দুইবার, বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ডাঃ ফজলে রাব্বী হলের মাঠে ক্রিকেট খেলেছি, বন্ধুবর ওভঃরশযধৎ ঐড়ংংধরহ সাক্ষী! আর ঢাকায় চাচা’র বাসার বারান্দার সিলিং এর লাইটতো অনেকবার ভেঙ্গেছি চাচাতো ভাই অশৎধস ঘঁসধহ এর সংগে খেলে। চাঁদপুরে থাকাকালে চাঁদপুর স্টেডিয়ামেও ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছি। তাই সাহস করে নেমে গেলাম কিশোর যুবকদের সংগে ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে। একাধারে আনন্দ এবং যুবকদের সাথে মতবিনিময়, দ্বিবিধ লাভ।
একদিন এজহারুল হক স্কুলেই এক প্রোগ্রামের মাইকিং হচ্ছে। আমার পছন্দের দুইজন অতিথি আসছেন কিন্তু আয়োজকরা আমাকে দাওয়াত করেননি। আয়োজকরা ভুল করতে পারেন আমি ভুল করি কিভাবে? অনুষ্ঠানের দিন সন্ধ্যায় অনাহুত আমি গিয়ে হাজির স্কুল মাঠে, অনুষ্ঠান স্কুলের বড় বারান্দায়, গিয়ে দর্শক সারিতে বসে গেলাম। আয়োজকরা বিব্রত, তাঁরা আমাকে ছোট মঞ্চেই জায়গা করে বসাবেন, আমি যাব না, এই করে শেষে তিনজন মহৎ ব্যক্তির সংগে মঞ্চে বসলাম। একজন অনুষ্ঠানের সভাপতি ‘বেশি দামে কেনা কম দামে বেচা আমাদের স্বাধীনতা”র লেখক অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আর বাংলা সাহিত্য জগতের দুই দিকপাল আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও হাসান আজিজুল হক। তিন জনেই মৃদুভাষী ভদ্রলোক। আয়োজকদের বললাম যে আমার প্রিয় দুই লেখক আসছেন বাঁশখালীতে আর আমি থাকব না এটা কি করে হয়। আর আয়োজকরা সঙ্গত কারণেই আমাকে দাওয়াত দেননি কারণ অনুষ্ঠান লেখক শিবিরের, লেখক শিবিরের অনুষ্ঠানে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসবেন এটা তাঁরা আশাই করতে পারেননি।
এই অনুষ্ঠানের সূত্রে অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন এর সংগে আমার যে সম্পর্ক স্থাপিত হয় তা দীর্ঘদিন অক্ষুন্ন ছিল। উল্লেখ্য চট্টগ্রামের ১০ মাসের জেলা প্রশাসক বিখ্যাত সিএসপি সৈয়দ আমিনুর রহমান যুগ্মসচিব থাকাকালে মারা গেলে চট্টগ্রামবাসী তাঁর উপর একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করে। সেই গ্রন্থের সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক আসহাবউদ্দিন। সৈয়দ আমিনুর রহমান চট্টগ্রামের আগে কুমিল্লায় জেলা প্রশাসক ছিলেন।
এখনকার প্রজন্ম ১৯৫৪ সালের সংসদ সদস্য অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন এর মত নির্লোভ নিষ্ঠাবান রাজনীতিক এর সংগে পরিচিত নয়। তিনি ১৯৩৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজে ও ১৯৪১ সালে চট্টগ্রাম ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ইংরেজীর শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি লাকসাম নওয়াব ফয়জুন্নেসা কলেজ, ফেনী কলেজ ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ১৯৫৩ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। তাঁর বাবা সফর আলী মুনশী ছিলেন চা বাগানের ম্যানেজার। এক দশকের শিক্ষকতার পর তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এক পর্যায়ে কম্যুনিস্ট পার্টির সংগে যুক্ত হন। পাকিস্তানে কম্যুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হলে তিনি গ্রেপ্তার হন ও এক বৎসর কারাভোগ করেন। তিনি এরপর ১৫ বছর আন্ডারগ্রাউন্ডে কষ্টকর জীবন যাপন করেন কিন্তু আপোষ করেননি। তিনি লেখক হিসেবেও উঁচুমানের ছিলেন এবং তাঁর রচনা ছিল সুখপাঠ্য। তাঁর বইগুলোর মধ্যে দাম শাসন দেশ শাসন, ভূমিহীন কৃষক কড়িহীন লেখক, ঘুষ, ধার, বোকামিয়ার ইতিকথা, আত্মগোপন জীবনের খন্ডচিত্র উল্লেখযোগ্য।