প্রবাস থেকে
এম এ আজিজ, লন্ডন থেকে

গরিবী হঠানোর জন্য মাতৃভূমি ছেড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রবাসীরা এসেছিল সাত সাগরের ওপারে। বিদেশ বৈভূবে পেয়েছে সোনার হরিণ। তাই প্রবাসীরা সোনার হরিণের পিছনে দিয়েছে ধাওয়া। বরফগলা ঠান্ডায় হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে দেশে গড়েছেন সম্পদ। স্বাধীনতা যুদ্ধে দিয়েছেন রক্ত। দেশ গড়ার জন্য দিয়েছেন অজশ্র টাকা। দেশের চাকা সচল রাখতে পাঠিয়েছেন রেমিটেনস। প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে হয়েছেন শরিক। অনেকের ছিল কত স্বপ্ন, কত পরিকল্পনা। কিন্তু নিয়তি করে দিয়েছে সব ওলটপালট। আচমকা অদৃশ্য ঘাতক করোনাভাইরাস দিয়েছে হানা। লাখ লাখ শবের মিছিলে প্রবাসীরা হতভম্ব। করোনার যাতাকলে বিলাতে জনজীবন আতংকিত। করোনা সংক্রমণের আশংকায় সবাই সন্ত্রস্ত। ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ রেখে কর্মহীন অবস্থায় মরণের ভয়ে সবাই ঘরবন্দি। তারপরেও গরজ বড় বালাই বলে একটা কথা আছে না। বেঁচে থাকার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় এবং নানাবিদ জরুরী কাজে আমাদেরকে বেরুতেই হয়। যদিও মরণ থেকে বাঁচার জন্য মুখে মাস্ক (উফা) পরে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হয়। পথ চলাচলে যাদের সাথে দেখা হয় তাদের সকলের চেহারায় থাকে আতঙ্কের ছাপ। কে কাকে সম্ভাষণ করবে। তাদের মনের ভাব দেখে মনে হয় কে যেন তাদেরকে পিছু ধাওয়া করছে। সবার মাঝে একটা দূঃশ্চিন্তা, অস্থিরতা ভাব। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী বা প্রতিবেশী ও পরিচিতজনের অকাল মৃত্যুতে সবাই বাকরুদ্ধ। ঘরে বন্দি থেকে আপনজন হারানোর শোকে সবাই কাতর। সবার মুখে ইয়ানাফসি ইয়ানাফসি। আমাদের আহাজারী কেউ শুনে না। একমাত্র মহান সৃষ্টিকর্তাই অবগত এবং তাহার উপরই ভরসা। আপনজন হারানোর ব্যাথার কোন উপশম নেই। ফলে পরস্পরকে সমবেদনা জানানো ও দোয়া করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। করোনাভাইরাসের সংক্রমিত রোগীর চাপে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসভূক্ত হাসপাতালসমূহ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অন্যান্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। হার্ট এ্যাটাকের মুমূর্ষ রোগীর বাসা থেকে ৯৯৯ বা ১১২ কল পেলে এ্যাম্বুলেন্স গিয়ে প্যারামেডিকরা বাসাতেই চেকআপ করে প্রয়োজনীয় জরুরী চিকিৎসা সেবাদান করে। এতেও যদি কাজ না হয় তখন সোজা হাসপাতালে। যাদের হায়াত আছে বা ভাগ্য ভাল তারা ইনপেসেন্ট হিসাবে চিকিৎসা সেবা পেতে পারে। রোগীর চাপে হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্সদের ত্রাহি-ত্রাহি অবস্থা। হাসপাতাল ছাড়া নিয়মিত ডাক্তার এচ বা সাধারণ প্র্যাক্টিশনারদের সাথে সাক্ষাতে দেখা করারও কোন সুযোগ নেই। ডাক্তারদেরকে অনলাইনে ব্যাধির কথা বলতে হয়। প্রেসক্রিপশন দেয়া হয় অনলাইনে। সার্বিকভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। এমনি দূঃসহ পরিস্থিতিতে সবার স্বপ্ন, ভূতভবিষ্যত পরিকল্পনা মূখ থুবরে পড়েছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে সবাই হতাশ। একা একা শুধু মুখে বিরবির করে আপন মনে নিজের সাথে কথা বলে সময় পার করছেন। হিসাব মিলছে না কারো। তাই প্রবাসীরা মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। সবাই ভূগছেন অবসাদ ও উদ্যমহীনতায়। এই বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে আমরা যারা বিভিন্নভাবে কমিউনিটিকে সাহায্য, সহযোগিতা ও মানবিক কাজে নিজের খেয়ে বনের মূষ তাড়ানোর কাজে নিয়োজিত ছিলাম তারাও পরিস্থিতির ভয়াবহতায় কিংকর্ত্যবিমূঢ়। তারপরও অনেকটা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফোনে সংক্রমিত রোগীর পরিবারের কাছে খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। প্রয়োজনে রোগীর পরিবারের পক্ষে রোগীকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ডাক্তার ও হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা তদবীর করা হয়। এমনকি যে সকল করোনা ভিকটিম পরিবারে কোন পূরুষ নেই বা বার্ধক্যতার কারণে পরিবারে জরুরী ভিত্তিতে খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী ঘরে ঘরে পৌছে দেবার চেষ্টাও সমাজকর্মীরা অব্যাহত রেখেছে। দূর্ভাগ্যজনক ভাবে যারা অকালে শাহাদাতবরণ করেন তাদের অনেকের ডেথ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে ফিউনারেল সার্ভিসের সাথে যোগাযোগ করে দাফন কার্য্য সম্পাদনে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানে সমাজকর্মীরা সদা প্রস্তুত। এছাড়া ভার্চ্যুয়াল মিটিং এর মাধ্যমে সমাজসেবকগণ বাংলাদেশী সমাজ সহ কমিউনিটিকে স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি ও মানসিক মনোবল বৃদ্ধি করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।
লকডাউনে বেকারত্বের অভিশপ্ত বন্দী জীবনে আতংকগ্রস্ত অবস্থায় সময় কাটানো দূরুহ ব্যাপার। দুঃসহ যন্ত্রণায় ঘুম নেই। তাই রাত জেগে সোনার হরিণের পিছনে যারা ধাওয়া করেছিল এবং যে রেমিটেনস উপার্জনকারীগণ স্বদেশ বিনির্মাণে রেখে যাচ্ছেন অবদান তাদেরসহ মানবজীবনের ভয়ানক ট্রেজেডির কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা ফেসবুক বন্ধুদের সাথে শেয়ার করলাম।
লন্ডন থেকে-
এম, এ, আজিজ
সমাজসেবক