বর্তমান সরকার সর্বক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে

মঈন উদ্দিন আহমেদ ॥ ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর ‘ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস ১৯৬৫’ জারি করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। এই বিধিমালা অনুসারে ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যে সব নাগরিক পাকিস্তান (পূর্ব পাকিস্তান) ত্যাগ করে ভারতে চলে যায়, তাদের পরিত্যাক্ত সম্পত্তি ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর, ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে শত্রু সম্পত্তির নাম পরিবর্তন করে ‘অর্পিত সম্পত্তি’ রাখা হয়। এই সব অর্পিত সম্পত্তি মূল মালিক বা তদীয় বৈধ উত্তরাধিকারীর কাছে ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে ২০০১ খ্রিস্টাব্দে ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন ২০০১’ প্রণয়ন করে সরকার। তবে তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বিধিমালা জারী না করায় আইন অনুসারে দীর্ঘকাল কোনোরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবার এবং ২০১২ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয়বারের মতো অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন সংশোধিত হয়। সংশোধিত আইনের ৯ ‘ক’ ধারা অনুুযায়ী সরকারি গেজেটে মৌজাভিত্তিক জেলাওয়ারি তালিকা প্রকাশের পর কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজেকে অর্পিত সম্পত্তির দাবিদার মনে করলে, তার দাবির সমর্থনে প্রয়োজনীয় প্রমাণাদিসহ সরকারি গেজেট প্রকাশের ৩০০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলা কমিটির সভাপতি অথবা ট্র্রাইব্যুনালে উক্ত সম্পত্তি অবমুক্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন।
এ ব্যাপারে হবিগঞ্জ জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট পূণ্যব্রত চৌধুরী বিভূ বলেন, পাকিস্তান সরকারের আমলে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়। ওই সময়ে অনেকেরই আত্মীয় স্বজন ভারতে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তারা স্থায়ীভাবে সেখানেই বসবাস করতেন। আত্মীয় স্বজনদের সাথে একত্রে বসবাসের জন্য অনেকেই ভারতে তাদের স্বজনদের কাছে চলে যান। যারা বাংলাদেশ ছেড়ে যান পাকিস্তান সরকার তাদের পরিত্যাক্ত সম্পত্তিকে ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। আর বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ‘শত্রু সম্পত্তি’ নাম পরিবর্তন করে তা অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে অভিহিত করে এবং তা প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়। প্রকৃত মালিক যাতে তার সম্পত্তি ফিরে পায় সে সুযোগ দেয়া হলে অনেকেই সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সম্পত্তি ফিরে পেতে প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি সহ আইনের আশ্রয় নেন। ফলে হবিগঞ্জে অনেকেই তার সম্পত্তি ফিরে পান। তবে বিচার বিভাগের বিলম্বের কারণে প্রয়োজনীয় প্রমাণাদির অভাবে অনেকের মামলা আটকে আছে। ফলে ওই সকল মামলার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের পক্ষ থেকে ভালভাবে তথ্য প্রমাণাদি যাচাই বাছাই করলে অনেক সম্পত্তি খুব দ্রুত অবমুক্তি হবে। তবে এ ব্যাপারে সরকার যতেষ্ট আন্তরিক বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি আরো বলেন, বর্তমান সরকার সর্বক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। যা অন্য কোন সরকারের আমলে ছিল না। সরকারের সদিচ্ছা আছে বলেই আইন সংশোধন করে প্রকৃত মালিকদের কাছে তাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে।
অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইন বাস্তবায়ন এবং সংখ্যালঘুদের পারিবারিক অর্থনীতিতে তার প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, পারিবারিক অর্থনীতি যোগ্যতার উপর নির্ভর করে। যোগ্যতা থাকলে কেউ কাউকে আটকে রাখতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, সত্যিকার অর্থে হবিগঞ্জের ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুরা একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছেন। এটি কারো দয়া বা করুনায় নয়। প্রত্যেকেই তাদের নিজেদের আদর্শ, যোগ্যতা ও সততার ভিত্তিতে করে যাচ্ছেন। যদিও অন্য সম্প্রদায়েরও কিছু প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী রয়েছেন। তবে তাদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে সংখ্যালঘু ব্যবসায়ীদের চেয়ে কম।
অর্পিত সম্পত্তি আইন বাস্তবায়নে বৈষম্যের ক্ষেত্র সম্পর্কে তিনি বলেন, ইউএনও, আরডিসি, ভূমি অফিসের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তরা যদি সঠিকভাবে তথ্য উপস্থাপন করেন তাহলে মামলা নিষ্পত্তি করা সহজ হয়। সম্পত্তির অবমুক্তি হয় দ্রুত। বলতে গেলে মামলা নিষ্পত্তি তাদের সদিচ্ছার উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। তবে আশার কথা হবিগঞ্জে এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে আশানুরূপ সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে। সহযোগিতার পরিধি বাড়ানো গেলে সম্পত্তির অবমুক্তি আরো বেশি হতো।
অর্পিত সম্পত্তি আইন বাস্তবায়নে সংখ্যালঘুরা কতটুকু একতাবদ্ধ ও তৎপর এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হবিগঞ্জে অর্পিত সম্পত্তি আইন বাস্তবায়নে জোটবদ্ধ হয়ে নয়, প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে আপিলের মাধ্যমে নিজেরাই নিজেদের সম্পত্তি আদায় করে নিচ্ছেন। তবে ধর্মীয় সম্পত্তি আদায়ে সাংগঠনিকভাবে দলবদ্ধ হয়ে বাধা বিপত্তি মোকাবেলা করতে হয়েছে।
অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইন পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন সম্পর্কে তিনি বলেন, সরকার যে পলিসি নিয়েছে তা অত্যন্ত সঠিক। শুধু দায়িত্বপ্রাপ্তদের সদিচ্ছা থাকলে অর্পিত সম্পত্তি সম্পর্কিত অনেক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। অনেক সম্পত্তি অবমুক্ত হবে। আইনের প্রয়োগ দ্রুত বাস্তবায়ন করা গেলে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইন পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
অর্পিত সম্পত্তি সংক্রান্ত আপিল ট্রাইব্যুনালের জিপি মোঃ আব্দুল মোছাব্বির বকুল বলেন, ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে পূর্ব পাকিস্তানের যে সকল নাগরিক তাদের সম্পত্তি রেখে ভারত চলে যায়, তৎকালীন আয়ূব সরকার এই সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি ঘোষণা করে নিজের হেফাজতে নেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু এই আইন সংশোধন করেন। এই সংশোধনের ফলে শত্রু সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি বা অনাগরিক সম্পত্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই সম্পত্তি অবমুক্ত করার কোন পদক্ষেপ কোন সরকারের আমলেই নেয়া হয়নি। ২০০১ সালে শেখ হাসিনা সরকার অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্তি বিধিমালা নামে একটি আইন প্রণয়ন করেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠন করলে ২০০১ সালের আইন কিছুটা সংশোধন করে। সংশোধনী আইন অনুযায়ী প্রকৃত কোন দাবিদার তার দাবির পক্ষে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করে তার দাবি সত্য প্রমাণ করতে সমর্থ হলে সরকার ওই সম্পত্তি তার অনুকূলে অবমুক্তি করে দেবে।
অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পন আইন বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, যারা বাংলাদেশের নাগরিক এবং আদালতে উপযুক্ত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বা ওয়ারিশান সূত্রে প্রমাণ করতে পেরেছেন দাবিকৃত সম্পত্তি তার নিজের, ওই সম্পত্তি অন্যের দখলে থাকলেও প্রশাসন তা উদ্ধার করে প্রকৃত মালিক/দাবিদারকে সমজে দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণডোরা ইউনিয়নের ব্রাহ্মণডোরা গ্রামের সুনীল ঋষি আদালতে মামলা করে সঠিক কাগজপত্র উপস্থাপন করে দাবিকৃত সম্পত্তি নিজের বলে প্রমাণ করতে সমর্থ হন। পরে আদালত সন্তষ্ট হয়ে তার পক্ষে অবমুক্তির রায় দেয়। এমনিভাবে জেলার নবীগঞ্জ উপজেলায় দলিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি তার সম্পত্তি ফিরে পেয়েছেন। তিনি বলেন, অর্পিত সম্পত্তি আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে হবিগঞ্জে কোন বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়নি। যদি বৈষম্য হতো তাহলে কেউই তাদের সম্পত্তি ফিরে পেতেন না। ইতোমধ্যে হবিগঞ্জে অনেকেই তাদের সম্পত্তি ফিরে পেয়েছেন। আর কিছু ক্ষেত্রে উপযুক্ত তথ্য প্রমাণের অভাবে কিছু মামলা আটকে আছে। তথ্য প্রমাণের অসঙ্গতি থাকায় এগুলো নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। তাছাড়া জেলা প্রশাসনের যে সকল দপ্তর এ কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট তারাও যথাসাধ্য সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের সহযোগি মনোভাব না থাকলে মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হতো না। অর্পিত সম্পত্তির বিধিমালা প্রয়োগের মাধ্যমে ইতোমধ্যে দলিত ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকেই উপকৃত হয়েছেন। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পন আইন বাস্তবায়নের ফলে দলিত সম্প্রদায়ের লোকজন বিশেষ করে সংখ্যালঘুরা উপকৃত হয়েছেন বেশি।