স্টাফ রিপোর্টার ॥ মুক্তিযুদ্ধকালীন চার নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর জেনারেল (অব.) সি আর (চিত্তরঞ্জন) দত্ত, বীর উত্তম আর নেই। গতকাল সকাল ৯টার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। তিনি বার্ধক্যজনিত জটিলতা সহ বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। তিনি দুই মেয়ে ও এক ছেলে রেখে গেছেন। মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্তের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এক শোকবার্তায় প্রেসিডেন্ট সি আর দত্তের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। শোকবার্তায় তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্তের ভূমিকা জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
সি আর দত্তের মৃত্যুতে পৃথক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদান দেশ ও জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে চিরদিন স্মরণ রাখবে।
প্রয়াত সি আর দত্তের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান প্রধানমন্ত্রী।
জানা গেছে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় তার মেয়ের বাসায় গত ২০শে আগস্ট বাথরুমে পড়ে যান। এতে তার পা ভেঙে যায়। এরপর তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। সি. আর দত্তের জন্ম ১৯২৭ সালের ১লা জানুয়ারি আসামের শিলংয়ে। তার পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি গ্রামে। তার বাবার নাম উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত এবং মায়ের নাম লাবণ্য প্রভা দত্ত।
শিলংয়ের লাবান গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে হবিগঞ্জে এসে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। হবিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে ১৯৪৪ সালে তিনি মাধ্যমিক পাস করেন। পরবর্তীতে কলকাতার আশুতোষ কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়ে ছাত্রাবাসে থাকা শুরু করেন। পরে খুলনার দৌলতপুর কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হন। পরে এই কলেজ থেকেই বিএসসি পাস করেন।
তিনি ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কিছুদিন পর ‘সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট’ পদে কমিশন পান। ১৯৬৫ সালে সৈনিক জীবনে প্রথম যুদ্ধে লড়েন তিনি। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের হয়ে আসালংয়ে একটা কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন তিনি। এই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে পুরস্কৃত করে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানী সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল এবং খোয়াই শায়েস্তাগঞ্জ রেললাইন বাদে পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে চার নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে সি আর দত্তকে দায়িত্ব দেন। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর সিলেটের রশীদপুরে প্রথমে ক্যাম্প বানান সি আর দত্ত। চারপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চা-বাগান। চা-বাগানের আড়ালকে কাজে লাগিয়ে তিনি যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি যুদ্ধে আক্রমণের সুবিধার্থে রশীদপুর ছেড়ে মৌলভীবাজারে ক্যাম্প স্থাপন করেন।
তিনি ১৯৭২ সালে রংপুরে ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সীমান্ত রক্ষা প্রহরী গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সরকার। এই বিষয়ে সি আর দত্তকে দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ সরকার। পরবর্তীকালে তিনি সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বাংলাদেশ রাইফেলস গঠন করেন। বর্তমানে এ বাহিনীর নাম বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম মহাপরিচালক। এ ছাড়া, ১৯৭১-এর পর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তাকে নানা ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি হেড কোয়ার্টার চিফ অব লজিস্টিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। ১৯৭৯ সালে বিআরটিসির চেয়ারম্যান হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮২ সালে তিনি পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত হন। এ ছাড়া ঢাকার কাঁটাবন থেকে কাওরান বাজার সিগন্যাল পর্যন্ত সড়কটি বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক নামে নামকরণ করা হয়। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com