মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহাব
(এক)
আমার গ্রামের চতুষ্পার্শ্বে কয়েক হাজার একর বোর (ইরি) জমি। বছরে মাত্র একটা ফসল। আবার এসব জমিতে আপাতত অন্য কোন কৃষিপণ্য উৎপাদনের কোন সম্ভাবনা বা সুযোগ নেই। প্রায় ছ’টা মাস কঠোর পরিশ্রমের পর বোশেখ মাসে তাড়াহুড়ো করে ঘরে ফসল তুলতে হয়। দ্বিতীয়ত এসময়টা প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও সময় বটে। অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি না হয় আগাম বন্যা দু’এক বছর পরপর একবার আঘাত আনবেই। তাই প্রতিটি পরিবারের সকল জমি স্বল্প সময়ে কেটে হাওর থেকে বাড়িতে নিয়ে আসতে অনেক কামলা বা দিনমজুরের প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ গ্রামে প্রায় পাঁচশত গৃহস্থ পরিবার থাকলে গড়ে প্রতি পরিবারে বিশজন করে হলে এই একমাসে কমপক্ষে দশহাজার দাওয়াল বা দিনমজুরের প্রয়োজন পড়ে উৎপাদিত ফসল ঘরে তোলার জন্য।
ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে অসহায় কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কতিপয় ভদ্র শিক্ষিতজন এমন কি প্রশাসনের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা দা কাস্তে নিয়ে দিনমজুর বেশে হাজির হচ্ছেন দরিদ্র কৃষকের পাশে। রাজনৈতিক পুরোধা ব্যক্তিত্বও কিন্তু বাদ নেই। নতুন সাদা লুঙ্গি, সফেদ গেঞ্জি ও নতুন গামছা সমেত ঘটা করে সেলফি তুলে প্রচারণা চালাচ্ছেন যে আমরা অসহায় হতদরিদ্র চাষাভুষাদের পাশে আছি। ব্যাপারটা আমি তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখছি না। বরং মন মানসিকতায় সহসা এ পরিবর্তন প্রশংসারই দাবি রাখে। যদিও নগর পরিচ্ছন্নতার নামে নগর পিতাদের রাস্তায় ছেড়া কাগজ ছিটিয়ে টাই পরে দলবেঁধে ঝাড়ু দেয়ার মহড়া বা ফটোসেশন আমার মত অনেকেরই মনোপোত হয়নি। বরং যে হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে তা ইতিহাসের পাতায় এক বালখিল্য অধ্যায় হিসেবেই স্থান করে নিবে।
যা বলছিলাম, প্রতি গ্রামে ফসলযুক্ত তোলার সময় যেখানে দৈনিক কয়েক হাজার শ্রমিকের প্রয়োজন সেখানে আমরা ঘটা করে নতুন পরিধেয় বস্ত্র পরিধান করতঃ কালের আবর্তে আজ হারিয়ে যাওয়া কৃষকদের কতটুকু সহযোগিতা করতে পারব বুঝে উঠতে পারছি না।
নাকি নগর পিতার পরিচ্ছন্নতা অভিযান তথা ঝাড়ু মিছিলের মতই হাস্যকর আর এক অধ্যায়ের নব সূচনা? এ কি কৃষকদের প্রতি পরিহাসের নামান্তর নয়? কয়টা কৃষকের ক্ষেতের ফসল আপনি কাটতে পারবেন? অথবা কত মিনিট বা কত ঘণ্টা? আরে দিন বাদ দেন। আপনার পেছনে ওই ভদ্র বিনয়ী সরল কৃষকের যে খরচ হবে বা সময় নষ্ট হবে তার হিসেব কষে দেখেছেন কি?
শুনুন! আমি চাষার ছেলে। আমাদের পূর্ব পূরুষের পেশা গৃহস্থী যা গর্বভরে বলার সৎ সাহস সতত ছিল এবং আছে। মনে পড়ে, মেডিকেলে ভর্তির ফরম পূরণের সময় পেশার কলামে শূন্যস্থানে ‘গৃহস্থী’ লিখার সময়ে আজ আমেরিকার রেনাল ফিজিওলজির বিখ্যাত অধ্যাপক ড. ডি এস এ মজিদ, পরবর্তীতে কিছুদিনের জন্য যার রুমমেট হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল, আমাদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। তখন স্বগর্বে বলেছিলাম আমাদের হাওরে জমি, গোলায় ধান, গোয়ালে গরু আর পুকুরে মাছ এটা বিধাতা প্রদত্ত এক বিরাট নিয়ামত। উনি ভাটি বাংলার তৎকালীন সুখী সমৃদ্ধ অবস্থা হৃদয় দিয়ে অনুভব করে আমার দিকে চেয়ে অর্থবোধক একটা মুচকি হাসি দিয়েছিলেন।
জানেন? তখন ছিল…
১ কেজি ধান = ৪০টা ডিম
১ কেজি ধান = ১ কেজি গরুর মাংস
১ কেজি ধান = ৫ কেজি ছোট চিংড়ি
২ কেজি ধান = ১টা ইলিশ মাছ (প্রায় ১ কেজি)
আর এখন…
১ কেজি ধান = ১টা ডিম
১ কেজি ধান = ২৫ গ্রাম গরুর মাংস (প্রায় ২ তোলা)
১ কেজি ধান = ১৭.৫ গ্রাম ছোট চিংড়ি
১ কেজি ধান = ১২.৫ গ্রাম ইলিশ মাছ (১ তোলা) অর্থাৎ প্রায় ৮০ কেজি তথা ২ মণ ধানের বিনিময়ে আপনি মোটামুটি ১ কেজি ওজনের ১টা ইলিশ মাছ কিনতে পারবেন।
সামান্য কিছু তুলনা তুলে ধরা হল মাত্র। তাই বলছিলাম, তখন গর্ব করার কারণ কিছুটা হলেও আপনার সচেতন বিবেক অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে বলে আশা করি।
চলবে….
লেখক: মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহাব
চিকিৎসক
© স্বত্ব দৈনিক হবিগঞ্জের মুখ ২০১৯
ওয়েবসাইটটি তৈরী করেছে ThemesBazar.Com